অন্দরের ঈদ: পুরুষদের চোখে নারী
রান্না করে, ঘর গুছিয়ে, আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর মধ্য দিয়েই উৎসবের দিনটা কেটে যায় নারীদের৷ সারাটা দিন ঘরের মধ্যেই পার হয় তাদের৷ এ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ কী বলছেন?
‘ঈদ আমরা উপভোগ করি, কিন্তু নারীদের বঞ্চিত করি’
ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোজাহার হোসেন বুলবুল বলেন, ‘‘আমাদের দেশে উৎসবে নারীদের অবদানকে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দেই না৷ ঈদের দিন সকাল থেকে রান্না-বান্না নিয়ে তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়৷ এর সঙ্গে অতিথি আপ্যায়ন আছে৷ ফলে ঈদটাকে যে উপভোগ করা, একটু বেড়ানো বা কোথাও যাওয়া সেটা তারা করতে পারেন না৷ আমি মনে করি, ঈদে নারীদের বিশেষ অবদান আছে৷ ...ঈদটাকে আমরা উপভোগ করি, কিন্তু তাদের বঞ্চিত করি৷”
‘উৎসবের পূর্ণতা পায় নারীদের ভূমিকার কারণে’
দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম বলেন, “উৎসবের পরিপূর্ণতা পায় মূলত নারীদের ভূমিকার কারণে৷ ঘরে-গৃহস্থলিতে তারা সবকিছু সামাল দেন৷ এই যে কোরবানি ঈদ গেল, এখানে মাংস আনার পর সেটার প্রক্রিয়া করা এবং রান্না করার কাজটা নারীরাই করেন৷ বিশেষ করে ঘরটাকে সামাল দেওয়া কিন্তু বড় একটা বিষয়৷ শুধু ঘরে না, বাইরেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই ভূমিকা না হলে হয়তো উৎসব পরিপূর্ণতা পেত না৷’’
‘ঈদের দিন তারা রান্না না করলে আমরা কোথায় খাব?’
শাহবাগের ফুল বিক্রেতা মো. সোহাগ বলেন, “ঘরের রান্না তো নারীরাই করবেন৷ পুরুষেরা বাইরে কাজ করেন, আর নারীরা ঘরে রান্না করেন৷ এখন ঈদের দিন তারা রান্না না করলে আমরা কোথায় খাব? এটাতে হয়ত তাদের কষ্ট হতে পারে৷ কিন্তু এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম৷ এটা নিয়ে নারীদের কোনো অভিযোগ কিন্তু নেই৷ কখনও তারা বলে না, আমরা রান্না করতে পারব না৷ এভাবেই পূর্বপুরুষদের আমরা দেখে এসেছি৷ এখনও সেভাবেই চলছে৷’’
‘নিজের নয়, পুরুষদের পছন্দের খাবার রান্না করে’
স্টাফ নার্স রেজাউল করিম বলেন, “ঈদের দিন নারীরা সকাল থেকে কাজ শুরু করেন৷ বাচ্চা থেকে শুরু করে স্বামীদের দেখভালের কাজটা তাদের৷ সকালের নাস্তা সেরে দিনের আসল রান্না শুরু করে৷ বিশেষ করে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কী খাবার পছন্দ করে সেই খাবারই তারা রান্না করে৷ অথচ নিজের কোন পছন্দের খাবার থাকলেও সেটা করেন না৷ ঈদের দিন তাদের আসলে তাদের সর্বোচ্চ বিনোদন হলো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে ঈদের কোন অনুষ্ঠান দেখা৷’’
‘উৎসবে অন্যরা বাইরে গিয়ে খায়, আমরা লোক ঘরে ডেকে খাওয়াই’
প্রযুক্তি পণ্য বিক্রয়কারী একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ইমরুল হাসান বলেন, ‘‘আমাদের সংস্কৃতিতে উৎসব মানেই বাসায় বিশেষ রান্নার আয়োজন৷ উৎসব সারা বিশ্বেই হয়৷ কিন্তু ওই সব দেশগুলোতে উৎসবে তারা বাইরে খায়৷ আর আমরা উৎসবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে বাসায় খাওয়াই৷ ফলে পরিবারের নারী সদস্যদের উপর একটা বাড়তি চাপ পড়ে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নারীদের বিশেষ দিনে রান্না করতে করতে দিন পার হয়ে যায়৷’’
‘সবাই মিলে কষ্ট করলেই তো খুশি থাকা যায়’
বরগুনা থেকে ঢাকায় এসে রিক্সা চালানো মো. সোহেল বলেন, “গিন্নিরা যে সারাদিন শুধু রান্না করে তা কিন্তু না৷ একসাথে আমরা টিভিও দেখি৷ আবার আত্মীয়ের বাড়িতেও কিন্তু যায়৷ তারা একটু বেশি কষ্ট করে৷ আমরাও কিন্তু বাইরে কম কষ্ট করি না৷ তাদের খুশি রাখার জন্যই তা আমাদের এত কষ্ট৷ দিন-রাত রিক্সা চালায় দু’টো টাকার জন্য৷ সবাই মিলে কষ্ট করলেই তো খুশি থাকা যায়৷ সন্তানদের দেখে রাখবে, রান্না করবে, এটাই তো তাদের কাজ৷’’
‘আপ্যায়নেই আনন্দ পান নারীরা’
আগারগাঁওয়ে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল রফিজ উদ্দিন বলেন, “নারীরা ঘরে রান্না করলে যে আনন্দ উপভোগ করতে পারে না, সেটা কিন্তু নয়৷ হ্যাঁ, তাদের কষ্টটা আমাদের চেয়ে বেশি৷ আপ্যায়নেও তারা কিন্তু আনন্দ খুঁজে পান৷ ছোট বাচ্চাদের তারা সাজগোজ করে দেন নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য৷ ঘরেও তারা নতুন পোশাক পরেন, সবাই মিলে একত্রে থাকার মধ্যেও কিন্তু আনন্দ আছে৷ সেই আনন্দটা তারা পান৷”
‘মিলেমিশেই আমরা আনন্দ উপভোগ করি’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রেই নারীরা গৃহকর্ম করেন৷ সবকিছু গুছিয়ে স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে আত্মীয় স্বজনের বাসায় যান৷ অনেক সময় হয়তো সম্ভব হয় না৷ করোনার এই পরিস্থিতিতে তো এখন আর কেউ বাইরে যাচ্ছেন না৷ ঘরেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটান৷ ফলে বাঙালির যে কালচার সেটা কিন্তু দুই বছর ধরে নেই৷ এখন তো সবাই ঘরের কাজে অংশ নেন৷ মিলেমিশেই আনন্দ আমরা উপভোগ করি৷”
‘রান্না করে খাওয়ানোতেই নারীদের আনন্দ’
মিরপুরের সিএনজি চালক মোরশেদ আলম বলেন, “ঈদের দিন তো নারীরা ঘরে রান্না করেই সময় পার করে দেয়৷ আত্মীয়-স্বজনকে বাসায় ডেকে খাওয়াতেই তাদের আনন্দ৷ আমরা যদি তাদের বলিও ঈদের দিন রান্না করতে হবে না৷ বরং তাহলে তারা কষ্ট পাবে৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাদের এই আনন্দ আমরা নষ্ট করতে চাই না৷ তাই তারা যেটাতে আনন্দ পায় সেটাই করতে দেওয়া উচিৎ৷’’
‘আত্মীয় স্বজন না এলে তারাই বেশি কষ্ট পান’
মেট্টোরেলের কর্মী সাইমুন হাওলাদার বলেন, “আমাদের মা, খালা, চাচী, ফুফুসহ আমাদের ঘরের স্ত্রী যারা আছেন তারা ঈদটাকে সেভাবে উদযাপন করতে পারে না৷ ঘর গোছানোসহ রান্নাতেই তাদের বেশি সময় যায়৷ এভাবেই তো চলে আসছে৷ এটার আসলে কোন পরিবর্তন হয়নি৷ ঈদে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন না এলে নারীরাই বেশি কষ্ট পান৷ এই রান্না করা, আর ঘরের কাজ করার মধ্যেই তারা আনন্দ খুঁজে পান৷”
‘উৎসবের দিনটা নারীরা আমাদের উৎসর্গ করে’
মিরপুরের শেওড়াপাড়ার ভোলা টি স্টলের স্বত্বাধিকারী মো. রাসেল মনে করেন, “সবচেয়ে সুন্দর দিনটা নারীরা আমাদের জন্য উৎসর্গ করে৷ ঈদের দিন তো সবাই আনন্দ করতে চায়৷ নারীরাও চায়৷ কিন্তু পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কথা ভেবে তারা এই আনন্দের দিনটা মাটি করে ফেলে৷ সারাদিন রান্না ঘরেই কাটিয়ে দেয়৷ আমাদের তো উচিৎ তাদের কাজে সহযোগিতা করা, সেটা তো আমরা করি না৷ উৎসবের দিনে নারীদের এই ত্যাগ আসলে আমরা স্বীকারও করি না৷’’
‘ঈদে খাবারের দোকান বন্ধ থাকে, ঘরে তো রান্না করতেই হবে’
একটি ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মী ইয়াদ আলী বলেন, “ঘরে ঈদের দিন নারীরা যে কাজ করে সেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে৷ শিক্ষিত-অশিক্ষিত নেই, সব নারীই ঈদের দিন ঘরের কাজে আনন্দ পান৷ আপনি যদি এটা বদল করতে চান, সেটা সম্ভব না৷ আমাদের দেশে কি ঈদে কোন খাবারের দোকান খোলা থাকে? থাকে না৷ তাহলে বাড়িতেই তো রান্না করতে হবে৷ সেই কাজটা তো নারীরা করবেন৷ এজন্য নারীরা কিন্তু আপনাকে কোন অভিযোগ করে না৷ এটাতেই তাদের শান্তি৷’’