অপর এক যোদ্ধাকে নিজের চোখ দান করেন মুক্তিযোদ্ধা ডলি
১৬ নভেম্বর ২০১১ডলি ফেরদৌস নামেই সমধিক পরিচিত তিনি৷ ১৯৫৪ সালে বগুড়ার সাতশিমুলিয়ায় জন্ম৷ বাবা আলহাজ্ব বজলুর রহমান এবং মা হাজি মালেকা চৌধুরী৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী ডলি৷ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন৷ রংপুরে তাঁর পিতার আসবাবপত্র তৈরির কারখানা ছিল৷ ফলে সপরিবারে তাঁরা রংপুরে ছিলেন৷ কিন্তু ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন শুরুর আগেই বিহারিরা তাঁদের উপর হামলা চালায়৷ তাই তাঁরা রংপুর ছেড়ে বগুড়া চলে আসেন৷
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের বাড়িতে গিয়েও রক্ষা পাননি তাঁরা৷ এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পাড়ি জমালেও পাক বাহিনী সেদিকেও ধাওয়া করে৷ গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে৷ এসময় তাঁর ভাইয়েরা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ভারত চলে যান৷ তবে ভাইয়েরা বিভিন্ন অভিযানের জন্য গ্রামে আসতেন৷ ডলির কাছে অস্ত্রশস্ত্র রাখতেন৷ ডলি এসব গ্রেনেড ও অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন এবং এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ করতেন৷ এসময় তাঁর ভাই ডলিকে গ্রেনেড দিয়ে নির্দেশ দেন যে, পাক সেনাদের হাতে পড়ে গেলে এবং বাঁচার কোন উপায় না থাকলে এই গ্রেনেড'এর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেবে৷ সেজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন ডলি৷
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ভাইদের সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন৷ এছাড়া ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের সাথে বিভিন্ন অভিযানেও যেতেন ডলি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘রাতের বেলা অভিযান চালিয়ে দিনের বেলা আবার নতুন জায়গায় পাড়ি জমাতে হতো৷ নতুন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতো৷ এমনকি ভাইয়েরা এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও বলতো যে, ডলি ছাড়া তো অভিযান সফল হয় না৷ তাছাড়া ডলি অভিযানে থাকলে আমরা যুদ্ধের মাঠ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হাতে পাই৷''
কিছুদিন পরে যোগ হয় রাজাকারদের তৎপরতা৷ রাজাকাররা তাদের গোপন তৎপরতা ও গেরিলা অভিযানের খবর পাচার করতো৷ ফলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে ভারত পাড়ি জমান ডলি এবং তাঁর পরিবার৷ ভারতের আসামের গোয়ালপাড়ায় আশ্রয় নেন তাঁরা৷ ১১ নম্বর সেক্টরের আওতায় কাজ শুরু করেন ডলি৷ সেখানে অস্ত্র চালনাসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ ত্রাণ শিবিরগুলোতে শিশুদের দুধ এবং অন্যান্য খাবার বিতরণের কাজ করেছেন৷ সেখানে দুধ ও খাবার বিতরণের কাজে ভারতীয় রেডক্রসের প্রধান স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷
মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে কাজ করার পেছনে ডলির সামনে অন্যতম উৎসাহ হিসেবে কাজ করে পাক সেনাদের এক নিষ্ঠুর আচরণ৷ তিনি বলেন, ‘‘একদিন সকালে আমাদের পাশের গ্রামে পাক সেনারা এসে এক প্রসূতি নারীকে ধর্ষণ করে এবং তারপর আবার বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে মারে৷ এমন ঘটনা দেখার পর আমার রক্ত যে মাথায় উঠল সেটা আমাকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ জুগিয়েছে৷ আমার মন্ত্র ছিল ভীরুর মতো মরার চেয়ে মেরে মরতে হবে৷ এছাড়া শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না৷ একমাত্র নেশা ছিল যেভাবেই হোক তাঁকে মুক্ত করে আনতে হবে৷ আর দেশকে স্বাধীন করতে হবে৷''
মুক্তিযুদ্ধের একটি কৌশলের ব্যাপারে কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন ডলি৷ এমনকি তিনি যুদ্ধের কমান্ডারদের বাধ্যও করেছিলেন তাঁর নীতির ব্যাপারে একমত হতে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ভারতীয় সেনা সদস্যরা আমাদের বেশ সহযোগিতা করেছে৷ কিন্তু মাত্র অল্পদিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদেরকেও সামনের সারিতে পাঠিয়ে দিতো৷ মাত্র সাতদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ঠিকমতো অস্ত্র চালনা রপ্ত করতে না পারলেও তাদের সামনে পাঠানোর বিরোধিতা করি আমি৷ এছাড়া দেশের ভেতর বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের ফেরত পাঠাতে চাচ্ছিল তারা৷ কিন্তু আমি তাতেও বাধা দিয়ে বলেছি যে, আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি সেখানে কী ভয়াবহ অবস্থা তাই তাদেরকে এখানে রেখে প্রস্তুত করতে হবে৷ এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের ভাইয়ের মতো যত্ন করে সুস্থ করে তুলতাম আমরা৷''
শুধু তাই নয়, দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখনও অনেকেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না যে, সত্যি বিজয় হয়েছে৷ তখন চিলমারির সাংসদ ফক্কু মিয়া তাঁকে ডেকে পাঠান যে, ডলি এসে বললেই সবাই বিশ্বাস করবে যে সত্যি দেশ স্বাধীন হয়েছে, বলে জানালেন এই সাহসী নারী৷
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করলেও এখনও প্রকৃত স্বীকৃতি মেলেনি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি৷ এমনকি ভারতীয় রেড ক্রস থেকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সনদ পেয়েছেন৷ কিন্তু স্বাধীন দেশে বঞ্চনার শিকার হন ডলি৷ দেশের সরকার পাল্টালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পাল্টে যায় - এমন ঘটনায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও লেখাপড়ায় মন দেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয় নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন ডলি৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক