অবসাদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে কৃত্তিকারা!
২৯ জুন ২০১৯মাত্র ১৪ বছরের এক কিশোরী। এই বয়সে তার স্বপ্ন দেখা শুরু করার কথা। তার আগেই প্রত্যাশার অতিরিক্ত চাপে অকালে ঝরে গেল প্রাণ। কলকাতার একটি নামী বেসরকারি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী কৃত্তিকার দেহ মিলেছে স্কুলেরই শৌচালয় থেকে। বাঁ হাতের কব্জিতে ক্ষত, মাথায় পরানো প্লাস্টিকের ব্যাগ। কেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি বেছে নিল ছোট্ট একটি মেয়ে, সেই প্রশ্ন আবার উস্কে দিয়েছে এই মৃত্যু। আত্মহত্যার কারণ নিয়ে অবশ্য বিশেষ ধোঁয়াশা রাখেনি কৃত্তিকা। সে তিন পাতার সুইসাইড নোট লিখেছে। তাতে স্পষ্ট তার মনের গভীর অসুখের কথা। মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেনি কিশোরী। লিখেছে, ‘‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।'' কিন্তু, সত্যি কি তাই? পরিবার ও সমাজ কি এর দায় এড়াতে পারে?
উদার অর্থনীতির পথে চলা শুরুর পর এখন প্রতিযোগিতাই মূল মন্ত্র। ভারত বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই। শিক্ষার মূল লক্ষ্য ভবিষ্যতে মোটা বেতনের চাকরি লাভ। সেজন্য সবাইকে টপকে সেরা ফল করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই শুরু এই প্রতিযোগিতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই চাপ সামাল দিতে পারছে না ছেলেমেয়েরা। একইসঙ্গে নিউক্লিয়ার পরিবারে বাবা-মা ছাড়া সন্তানকে দেখভালের কেউ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা চাকরি করেন, পুত্র-কন্যার সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। এর ফলে কিশোর-কিশোরীর মনের খবর অভিভাবকদের কাছে থাকে না। তারা নিজেদের সমস্যা প্রকাশের সুযোগ পায় না। অবসাদ গভীর হলে এভাবেই নিজেকে শেষ করে দেয়।
গত বুধবার কলকাতার অন্য একটি বেসরকারি স্কুলে একই ভাবে শৌচাগারে ঢুকে নিজের কব্জিতে ক্ষত তৈরি করেছে আরো এক ছাত্রী। তার কাছে ছিল ছুরি জাতীয় ধারালো কোনও বস্তু। অন্য ছাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করেও মিলেছে একাধিক শার্পনার। অর্থাৎ, পড়ুয়ারা তাদের ব্যাগে বইপত্র, টিফিনের সঙ্গে এ ধরনের জিনিস রাখছে যা দিয়ে আত্মহত্যা করা যায়।
যৌন হেনস্থা রুখতে শহরের স্কুলে স্কুলে বসেছে ক্লোজ সার্কিট টিভি। তা দিয়ে নজরদারি চালান স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রকাশ্য স্থানে কিছু ঘটাতে গেলে নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই শৌচাগারকে বেছে নিচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। কৃত্তিকার আত্মহত্যার জেরে বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্ট স্কুলের নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে ফের পরামর্শ দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। শুধু ক্লোজ সার্কিট টিভিতে নজরদারি নয়, এবার শৌচাগারের বাইরে প্রয়োজনে সহায়ক নিয়োগ করার কথা বলেছেন বিচারপতি। অর্থাৎ, শৌচালয়ে ঢোকার মুখে পড়ুয়ার হাবভাব লক্ষ্য করবেন সহায়করা। কলকাতার স্কুলগুলিতে মোট শৌচালয়ের সংখ্যা ও কত জন সহায়ক নিয়োগ করা দরকার, সেটা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। স্কুলের নিরাপত্তা নিয়ে দ্রুত বৈঠক করবে কলকাতা পুলিশও।
এ সবই বাহ্যিক নিরাপত্তা, ক্ষতে মলম দেওয়ার চেষ্টা বলে মনে করছেন মনস্তত্ত্ববিদ থেকে চিন্তাশীল মানুষেরা। তাঁদের প্রশ্ন, ভেতর থেকে যে বিপন্ন, তাকে বাইরে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলল কী লাভ হবে? কলকাতার নামী স্কুল লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লসের এক ছাত্রীর অভিভাবক ডয়চে ভেলের প্রশ্নের মুখে স্বীকার করেন, পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ রয়েছে ছেলেমেয়েদের উপর। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুরো ব্যবস্থাটাই এমন যে তা থেকে বেরোনো যাচ্ছে না। স্কুলে ভর্তি হলে নিয়মিত পড়া চালিয়ে যেতে হবে। একটু ঢিলে দিলেই পিছিয়ে পড়বে। তাতে ফল খারাপ হবে। ভবিষ্যতে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাবে না।'' এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সমাজে ইঁদুর দৌড় একটা অনিবার্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
এর কোনও প্রতিকার আছে কি? কলকাতার শীর্ষস্থানীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কামাল হোসেন বলেন, ‘‘বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে সন্তানের সঙ্কট দূর করতে। পেশাগত ব্যস্ততা যাই থাক, এটা তাঁদের দায়িত্ব। ছেলেমেয়ের চালচলনে কোনো বদল হচ্ছে কি না, সেটা দেখতে হবে। অর্থের বিনিময়ে তার পছন্দের সামগ্রী কিনে দিলেই দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না।'' কৃত্তিকা কিন্তু হাসিখুশি ছিল, আত্মহত্যার কিছুক্ষণ আগেও সে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে সহপাঠীদের সঙ্গে। তাহলে কি হাবভাব দেখে মনের হাল বোঝা সম্ভব? ডা. হোসেনের পরামর্শ, ‘‘ওরা যতই দুঃখে থাক, বাইরে নিজেকে পরাজিত দেখাতে চায় না। কারণ তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাই হাসিখুশি থাকে। অভিভাবককে সময় খরচ করে সন্তানের মনোভাব বুঝতেই হবে। নইলে এই পরিণতি থেকে মুক্তি নেই।''