নারী মুক্তিযোদ্ধা যশোরের মীরা রানী সরকার
২৮ ডিসেম্বর ২০১১নড়াইল জেলার পাইকড়া গ্রামে ১৯৪৭ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধা মীরা রানী সরকার৷ পিতা রসিক লাল এবং মা তপি বালা৷ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নবম শ্রেণীর ছাত্রী৷ তাঁদের এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আনাগোনা শুরু হলে অনেক হিন্দু পরিবার এলাকা ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ তিনিও ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে হেঁটে নড়াইলের পাইকড়া গ্রাম ছেড়ে চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান৷ বনগাঁও হাসপাতালের পাশে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে তাঁরা সেখানে ছিলেন৷
স্থানীয় কালু বাবুর বাড়িতে আওয়ামী লীগের অফিস ছিল৷ সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছার কথা বলেন৷ কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন - এমন প্রশ্নের উত্তরে মীরা রাণী বলেন, ‘‘আমি যুদ্ধে গিয়েছি এই কারণে যে দেশ স্বাধীন করবই৷ আমি অফিসে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছি৷ তখন তারা জিজ্ঞেস করল যে, তুমি কি পারবে? এই গোলাগুলির মধ্যে তুমি কি কাজ করতে পারবে? আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ আমি পারবো৷ আমার বুকে সেটুকু বল আছে৷''
সেখানে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর টালিখোলা মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন৷ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি নড়াইলের মতিউর রহমান তাঁদের কমান্ডার ছিলেন৷ পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা জাদুঘরের পেছনে ১২ দিন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন৷ এরপর তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগানোর কাজ দেওয়া হয়৷ তিনি ভারতের হেলাঞ্চা, বাগদা, গোপালনগর, চাঁনপাড়া মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য নানাভাবে সাহস জুগিয়েছেন৷ পাশাপাশি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন৷ ঝিনাইদহ ও যশোরের বিভিন্ন শিবিরেও তিনি চিকিৎসা সেবায় সহযোগিতা করেছেন৷
মীরা রানী জানান, একদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের শিবিরে যান৷ তিনি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন৷ তাঁর কাজের প্রশংসা করেন এবং উৎসাহ দেন৷ এছাড়া তাঁকে একটি প্রশংসা পত্রও দেন ইন্দিরা গান্ধী৷ এরপর মীরা রানী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে চৌগাছা সীমান্তে যান৷ ঐ সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়৷ সে যুদ্ধে তাঁর এক সঙ্গী শহীদ হন৷ বিভিন্ন অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে গিয়েছেন এবং তাঁদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন মীরা রানী৷
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের কাজে আমরা ১২ জন মেয়ে ছিলাম৷ আমাদের মধ্যে একজন মেয়ে শহীদ হয়েছিল৷ তাঁর বাড়ি ছিল মাগুরায়৷ তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল বনগাঁ হাসপাতালের সামনে৷ সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও সেখানে এসেছিলেন৷''
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন মীরা রানী সরকার৷ তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যান৷ বঙ্গবন্ধু তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘শাবাশ বেটি'৷ সে সময় তাঁকে এক হাজার টাকা পুরস্কারও দিয়েছিলেন শেখ মুজিব৷
স্বাধীনতার দুই বছর পর পূর্ব পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা পশুপতি সরকারের সঙ্গে বিয়ে হয় মীরা রানীর৷ এর মধ্যে তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়৷ টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসক দেখাতে পারেন না৷ তাঁর এক মেয়ে বিএ পাস করেছেন৷ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযোদ্ধার কোটায় তিনি কোনো চাকরি পাননি৷ মীরা রানী এবং তাঁর পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ছেলে বিপ্লব সরকার বলেন, ‘‘এটা কষ্টকর বিষয় যে, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব অবহেলিত রয়ে গেছেন৷ তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে৷ কথাও বুঝতে পারেন না৷ আর আমাদের পরিবারের অবস্থা এমন যে কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছে৷ আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের যে অবস্থা, আসলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তো এখানে মুক্তিযোদ্ধাই না এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আসলেই অবহেলিত৷''
বর্তমানে যশোর উপশহরে বাস করছেন মুক্তিযোদ্ধা মীরা রানী৷ এ বছরের বিজয় দিবসে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে৷ মহান বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী বিজয় মেলার সমাপনী দিনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের পক্ষ থেকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ