‘একুশ আমাদের পরিচয়’
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
অবরোধ আর হরতালের মধ্যে ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার বাংলা একাডেমির এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথম চারদিন ছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন৷ এই সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে ইউরোপ, অ্যামেরিকা ও এশিয়াসহ বিশ্বের ১২টি দেশের ৪৩ জন কবি-সাহিত্যিক অংশ নেন৷ এর মধ্যে ২৫ জন ভারতের কলকাতা, আসাম, ত্রিপুরা ও মাদ্রাজসহ বিভিন্ন প্রদেশের কবি-সাহিত্যিক৷ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সাহিত্য সম্মেলনের শেষ দিনে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী বিনির্মাণে সাহিত্যের চিরকালীন স্বরকে আরও শাণিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তাঁরা৷
সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার৷ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে মানব-ঐক্য, সহিষ্ণুতা ও শান্তির প্রতি লেখক-কবিদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়৷ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটি ছিল এক ঐতিহসাকি সাহিত্য সম্মেলন৷ এতে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্যমাধ্যমের উপস্থাপনা ও পরিবেশনায় শ্রোতা-দর্শক সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা লাভ করেছেন৷ ভাষার জন্য বাঙালির অনন্য আত্মত্যাগ যেমন বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তেমনি এ ধরনের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে বাংলা সাহিত্যের সংযোগ প্রসারিত হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই সাহিত্য সম্মেলন আমাদের সাহিত্যজগতে ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি করেছে৷ ভবিষ্যতে আমরা দ্বিবার্ষিকভাবে, মানে প্রতি দু'বছর পর পর এই সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করব৷''
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘‘এই আয়োজন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যেমন বিশ্বে ছড়িয়ে দেবে, তেমনি বিদেশি কবি সাহিত্যিকদের কাছ থেকে আমরা সমকালীন বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে পারব৷ এই ধরণের আয়োজন মেলাকে আন্তর্জাতিক রূপও দেবে৷''
রবিবার ১লা ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ একই মঞ্চে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে আসা বিদেশি অতিথিদের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জার্মানির হাইডেলব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষাবিদ ও গবেষক হান্স হার্ডার, ফরাসি লেখক ফ্রঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য গবেষক ও ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার৷
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জার্মানির হান্স হার্ডার বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে, বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার কথা জানিয়ে উপস্থিত সবার হৃদয়ে আসন করে নেন৷
তিনি বলেন, ‘‘বন্ধু স্বজন....আমি জার্মান মানুষ হলেও বাংলা সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী৷ তাই আমান্ত্রণ পেয়ে আনন্দিত হয়ে ছুটে এলাম৷ ঢাকার একুশে বইমেলার সরগরম পরিবেশ আমি উপভোগ করব৷ আমিও বইয়ের পাতায় নাক গুঁজে নেশা করব৷''
তিনি মির্জা গালিবকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘বই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়, একটি নতুন বই, একটি নতুন পদক্ষেপ৷'' শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও তুলে ধরেন তিনি৷ বলেন, একমসয় নারীরা বাংলা উপন্যাস পড়ত লুকিয়ে৷ এ কথা বলতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় উপন্যাসের প্রসঙ্গ টানেন৷
তিনি বলেন, ‘‘এই আধুনিক ইন্টারনেটের যুগেও বইয়ের গুরুত্ব কমেনি, কমবে না৷ এই বইমেলার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে৷ বাংলাদেশের মানুষের ভাষার জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের কথা সবার জানা৷ আর এই ভাষা থেকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে৷ এটা আমাদের, মানে বিদেশিদের ঐ সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়৷''
হান্স হার্ডার একজন জার্মান দার্শনিককে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘ভাষাই মানুষের যথার্থ আবাসন৷'' আর তাই যদি হয় তাহলে ভাষাকে খাতির করা, যত্ন করা আমাদের কর্তব্য, বলেন তিনি৷
তাঁর এই বক্তৃতার সময় মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নিজে করতালি দেন বার বার৷ মুগ্ধতার হাসি তাঁর মুখে লেগেই ছিল৷ এছাড়া দর্শকদের মধ্যে ছিলেন সরকাররের মন্ত্রি পরিষদের সদস্য, পদস্থ কর্মকর্তাসহ কবি, সাহিত্যিক এবং শিল্পবোদ্ধাসহ বই প্রেমিকরা৷ তাঁরাও বার বার করতালিতে ফেটে পড়েন৷
গবেষক ও ভাষাবিদ হান্স হার্ডারের বাংলায় বক্তৃতা নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে ব্যাপক উচ্ছ্বাস৷ একজন তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হয়ে গেল৷ ভাষার মাস, বইমেলার মাস৷ এই মাসে জার্মানির এই ভদ্রলোক প্রফেসর ডক্টর হান্স হার্ডারের মুখে এত চমত্কার বাংলা শুনে আমি মুগ্ধ৷ ওনার মতো এত দারুণভাবে আমরা অনেকেই বাংলা বলতে পারব না৷ আর আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি আমাদের অনেকের চেয়ে বাংলার ইতিহাস উনি বেশি জানেন৷ ওনার ব্যবহার করা শব্দগুলো কত সুন্দর! কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আবার মজাও করেন বাংলাতে, ‘সেন্স অফ হিউমার'-ও খুব ভালো৷’’‘‘প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ওনার কথা শুনে হাসছিলেন, মুগ্ধ হচ্ছিলেন৷ উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে কথা বলে গেলেও সেটা শুনে ক্লান্ত হবো না...৷''
চারদিনের আন্তর্জাতিক সহিত্য সম্মেলনে আসা বিদেশি কবি-সাহিত্যিকরা বইমেলা ঘুরে দেখেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, বই কিনেছেন৷ সম্মেলনের শেষ দিন বুধবার ভারতের লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বইমেলায় সেলফিও তুলেছেন৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন, ফ্রান্সের সাহিত্যিক ফ্রঁস ভট্টাচার্য৷ ফ্রঁস ভট্টাচার্য বইমেলা নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি দেশের ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ সেটি বাংলাদেশের৷ তখন থেকেই আমি বাংলা ভাষার ভক্ত৷ আর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বই নিয়ে এত বড় মেলা, সত্যিই অপূর্ব৷ আমার মন ভরে গেছে এ মেলা দেখে৷''
এ পর্যন্ত বইমেলায় ছয় শতাধিক নতুন বই এসেছে৷ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এবারের মেলায় প্রায় ৪ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হবে৷
মেলা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ও বাংলা একাডেমি চত্বরে দু'ভাগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এ বছর মেলায় মোট ৩৫১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে৷ মেলা প্রাঙ্গনে মোট ৫৬৫টি ইউনিট ও ১১টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে৷ এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মোট ২৯৫টি বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে ৪৭৫ ইউনিট স্টল রয়েছে৷ ১০টি প্রতিষ্ঠানকে প্যাভিলিয়ননের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে৷ আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান মূল একাডেমি অঙ্গনে স্টল করেছে৷
অবরোধ-হরতালে মেলায় দর্শনার্থীদের আগমন কম হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে৷ কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘‘পরিস্থিতির কারণে বইমেলায় কিছুটা ম্রিয়মান সত্য৷ তবে বাঙালির প্রাণের এই মেলায় শেষ পর্যন্ত সবাই আসেন৷ আসবেন৷''
‘একুশ আমাদের পরিচয়' – এই স্লোগান নিয়ে ৫২-র ভাষা শহিদদের স্মরণে ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রতি বছর আয়োজন করে আসছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ সেই মেলা এখন বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে৷ পরিণত হয়েছে বাঙালির মননশীলতার প্রতীকে৷