আইএমএফের ঋণেও রিজার্ভ সংকট কাটবে না
১২ ডিসেম্বর ২০২৩ওয়াশিংটন ডিসিতে মঙ্গলবার সেখানকার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় আইএমএফের বোর্ড সভা বাংলাদেশের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় নিয়ে বৈঠকে বসছে৷ বাংলাদেশের স্থানীয় সময় তখন রাত ৮টা৷ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করা হলে বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাবে এই মাসেই৷ গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৯ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার পায়।৷ মোট ছয় কিস্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে মোট ৪৭০ কোটি ডলার ছাড়ের কথা৷
অবশ্য আইএমএফ প্রত্যেক কিস্তি ছাড়ের সময় পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের শর্ত ঠিক করে দেয়৷ গত অক্টোবরে আইএফএফের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে৷ তখন বাংলাদেশ দুইটি শর্ত পুরণ করতে ব্যর্থ হলেও আইএমএফের রিভিউ মিশনের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ ছাড়ের ব্যাপারে একমত হয়ে আইএমএফ বোর্ডে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেন৷ আইএমএফের শর্ত ছিলো নিট রিজার্ভ ২৪.৬ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে৷ সেটা বাংলাদেশের ছিল না৷ আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয় এনবিআর৷ তবে বাংলাদেশর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ওই দুইটি শর্তে কিছুটা ছাড় দেয় আইএমএফ৷
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের ব্যাপারে আইএমএফ যে রিভিউ করেছে সেখানে কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের ব্যাপারে আমি কোনো আশঙ্কা দেখিনি৷ যদিও বাংলাদেশ দুইটি ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ করতে পারেনি তারপরও আমার মনে হয়েছে আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় করবে৷''
আর বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,‘‘দ্বিতীয় কিস্তি বাংলাদেশ সহজেই পেয়ে যাচ্ছে৷ কারণ যখন বোর্ড সভায় ওঠে তার আগেই চড়াই উৎরাই পার হয়ে যায়৷ ফলে এই কিস্তি বাংলাদেশের পেতে কোনো সমস্যা হবে না৷ প্রত্যেক কিস্তি ছাড়ের আগেই আইএমএফ মূল্যায়ন করে৷ দ্বিতীয় কিস্তিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে রিজার্ভ এবং রাজস্ব আয়ের টার্গেটে ছাড় দিয়েছে৷ আর ব্যাংকিং খাতে সুদের হার, ডলারের ফ্লোটিং রেট-এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে৷ কিন্তু তৃতীয় কিস্তির সময় ওই শর্তগুলো আবার আসবে৷''
বাংলাদেশ এখন রিজার্ভ এবং ডলার সংকটে ভুগছে৷ ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে৷ সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম৷ ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিলো ৪৮ বিলিয়ন ডলার৷ তাই আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে কতটা ভূমিকা রাখবে?
এর জবাবে ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘প্রয়োজনের তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ তত বেশি না৷ তারপরও ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ যদি আমরা ঋণের এই কিস্তিটা পাই তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে৷ তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাংলাদেশের এই অর্থনেতিক সংকটের সময় আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়া ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে৷ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে৷''
তিনি বলছেন, ‘‘বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও কিছু ঋণ পাওয়া যাবে৷ আইএমএফের ঋণ ছাড় তাতে সহায়তা করে৷ আইএমএফের মূল্যায়ন সবাই ফলো করে৷ আইএমএফ যখন প্রথম ঋণ দিল তারপর কিন্ত বিশ্বব্যাংকও ঋণ দেয়৷ তবে বাংলাদেশ রিজার্ভসহ পুরো অর্থনীতি নিয়ে যে গভীর সংকটে আছে তা আইএমএফের এই অল্প পরিমাণ ঋণ দিয়ে কাটানো সম্ভব নয়৷ এজন্য সবার আগে প্রয়োজন অর্থনেতিক সংস্কার৷ কিন্তু সংস্কারের বিষয়গুলো এখনো সুস্পষ্ট করা হচ্ছে না৷ বলা হচ্ছে নির্বাচনের পরে করা হবে৷ আমার মনে হয় নির্বাচনের আগে রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা দরকার ৷''
আইএমএফ যে শর্ত বাংলাদেশকে দিয়েছে তার মধ্যে প্রধান তিনটি শর্ত হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে হবে, বেঁধে দেয়া লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে হবে এবং ঋণ খেলাপি ও ঋণের অব্যবস্থাপনা কমাতে হবে৷
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘আইএমএফের বোর্ড বৈঠকের পর জানা যাবে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেতে বাংলাদেশকে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে৷ তারা তাদের এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট তাদের ওয়েবসাইটেই প্রকাশ করবে৷ এইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির যে অর্থ তা দিয়ে রিজার্ভ সংকটের তেমন কিছু করা যাবে না৷ এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক থেকে বাজেট সহায়তা হয়তো ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে৷ এডিবি থেকেও কিছু পাওয়া যাবে৷ কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তো মাসে এখন ১০০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করছে৷ আইএমফের দ্বিতীয় কিস্তি ওই ডলারের চার ভাগের তিন ভাগ মাত্র৷ ফলে রিজার্ভে এটা সামান্যই ভূমিকা রাখবে৷ রিজার্ভের যে পতনের ধারা তা রোধ করতে হলে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে৷''
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে চলতি মাসে রিজার্ভ কমবে না৷ এই মাসে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও বাজেট সহায়তা আসবে৷