আরব বিপ্লব ও জার্মানিতে মুসলিমদের ভাবমূর্তি
১৬ জুন ২০১১নেতিবাচক ভাবমূর্তি
জার্মানিতে মুসলিম সমাজের ভাবমূর্তি মোটেই ইতিবাচক নয়৷ শোনা যায়, শিক্ষা থেকে তারা নিজেদের দূরে রাখে, হিংসার পথে চলতে তাদের বাধ সাধে না, সমাজে তারা পিছিয়ে রয়েছে৷ বিতর্কিত জার্মান রাজনীতিক টিলো সারাৎসিন তাঁর সাম্প্রতিক বইয়ে মুসলিম সমাজ সম্পর্কে এমন আরও অনেক নেতিবাচক ধারণা তুলে ধরেছেন৷ কিন্তু গত প্রায় ২ মাস ধরে টেলিভিশনের পর্দায় যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা সকলকে বিস্মিত করছে৷ স্বৈরচারী শাসকদের পতনের দাবিতে আরব জগতে মুসলিম তরুণ-তরুণীরা পথে নেমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাচ্ছে৷ মিশরে তারা খ্রীষ্টানদের সঙ্গে একযোগে শান্তির জন্য প্রার্থনা করেছে৷ লিবিয়ায় নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছে৷ আরব জগতের এই বিপ্লবের হাওয়া বিশ্বমঞ্চের রসায়ন যে বদলে দিচ্ছে, এবিষয়ে আর তেমন কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু জার্মানিতে তার কতটা প্রভাব পড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও স্প্যানিশ ইমাম আব্দুলহাসিব কাস্তিনেরা এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘আমার মনে হয়, বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের মনে যে সব গতানুগতিক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা ভেঙে দিলে ভালোই হবে৷ পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিমদের ভাবমূর্তি যে ভুল ও এর মাধ্যমে তাদের প্রতি যে সত্যি অন্যায় করা হচ্ছে, এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে ভালোই হবে৷ কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই কঠিন পরিশ্রম করে এবং তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়৷ তারা নিজেদের ও আশেপাশের মানুষদের কল্যাণ চায়৷ কে মুসলিম, বা কে মুসলিম নয়, তা নিয়ে তারা মোটেই ভাবে না৷''
আরব জগতে বিস্ময়কর পরিবর্তন
নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসী হামলার ১০ বছর পর সেই সব মানুষ জেগে উঠছে, পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা ধর্মীয় মৌলবাদী অথবা যারা নিজেদের নিয়তি মেনে নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে৷ অথচ এখন জার্মানির টেলিভিশন দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন, কীভাবে মরক্কো থেকে ওমান পর্যন্ত মানুষ নিজেদের অধিকারের দাবি জানাতে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে৷ তারা চায় প্রকৃত স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধি৷ নতুন এই পরিস্থিতির আলোকে কি জার্মানিতে বসবাসরত মুসলিমদের ভাবমূর্তিও বদলে যাবে? এতকাল অনেকে বিশ্বাস করতো, যে মুসলিমরা জন্ম থেকেই গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়৷ এখন তারা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে৷
চেতনা বদলাচ্ছে জার্মানিতে বসবাসরত মুসলিমদেরও৷ যেমন আজিমা মুস্তফা৷ প্রায় ১০ বছর আগে তিনি সিরিয়া থেকে জার্মানি এসেছিলেন৷ আরব বিশ্বের ঘটনাবলি দেখে এখন তাঁর মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে৷ একদিকে টিউনিশিয়া ও মিশরে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখে তিনি গর্বিত৷ অন্যদিকে তিনি নিজের দেশে বিদ্রোহের ঘোরতর বিরোধী৷ তাঁর আশঙ্কা, সিরিয়া ক্রমশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ তবে এসব ঘটনার ফলে জার্মানিতে বসবাসরত মুসলিমরা তাদের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই ফিরে পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন৷
জার্মানির পরিস্থিতি
আজিমা বললেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, আরব ও মুসলিমদের ভাবমূর্তির আরও উন্নতি হবে৷ এতকাল সবাই ভাবতো, আরবরা আসলে গণতন্ত্র চায় না৷ কিন্তু টিউনিশিয়া, মিশর ও লিবিয়ার ঘটনা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে আরব জনগণও গণতন্ত্র চায়৷''
জার্মানিতে বসবাসরত ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ মুসলমানই তুর্কি বংশোদ্ভূত৷ বাকিদের একটা বড় অংশ বল্কান দেশগুলি ও পাকিস্তান থেকে এসেছেন৷ অর্থাৎ আরবদের সংখ্যা নিতান্তই কম৷ ফলে অনেকে মনে করছেন, আরব বিশ্বের ঘটনাবলি জার্মানিতে ইসলাম সংক্রান্ত বিতর্কের উপর তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না৷ এর আরও একটা কারণ হলো, সেখানে যে বিদ্রোহ ও আন্দোলন চলছে, তার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই৷ জার্মানি তথা ইউরোপে মুসলিম সমাজের সমস্যাগুলির কারণ হিসেবে সাধারণত ইসলাম ধর্মকেই দায়ী করা হয়৷ অন্যদিকে আরব বিশ্বে বিপ্লবের মূল কারণ সেখানকার পরিস্থিতি৷ তা সত্ত্বেও জার্মানিতে মুসলিমদের ভাবমূর্তির পরিবর্তন সম্ভব বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন৷
তবে এক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমকে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে৷ টেলিভিশনের ‘টক-শো'গুলিতে সাধারণত দেখা যায়, মুসলিম বক্তারা বেশ লাজুক প্রকৃতির হন৷ ধরে নেওয়া হচ্ছে, আরব বিশ্বের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের আলোকে তারা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের বক্তব্য রাখতে পারবেন৷ তবে হাতে গোনা কয়েকজন খ্যাতিমান, প্রগতিশীল মুসলিম বক্তা হয়তো গোটা সমাজের ভাবমূর্তি বদলাতে পারবেন না৷ তার উপর তাদের এই নেতিবাচক ভাবমূর্তি ভাঙিয়ে সংবাদ মাধ্যম সাফল্য পেয়ে অভ্যস্ত৷ সন্ত্রাস, অশিক্ষা, হিংসা সংক্রান্ত ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মুসলিম হলে সেই খবর বেশ ফলাও করে ছাপা যায়৷ সেখানে আরব জগতে গণবিপ্লব তেমন গুরুত্ব পায় না৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ