আশা ও আশঙ্কার নির্বাচন
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম সব রাজনৈতিক দল কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দল৷
পরে আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলে একই বছরের জুন মাসের নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়৷
২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে৷ ওই নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেয়নি৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে৷ সেই মেয়াদের শেষে এবার আবার আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হচ্ছে৷
২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগ৷ এই একপাক্ষিক নির্বাচনের পর সমালোচনায় পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার৷ আর বিএনপি-জামায়াত জোটও নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়৷
বিএনপি এবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করলেও তারা শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে গত ২৮ বছরে এবারাই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷
৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হচ্ছে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে৷ গাইবান্ধা-৩ আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে সেখানকার নির্বাচন পিছিয়ে গেছে৷ ওই আসনে নির্বাচন হবে ২৭ জানুয়ারি৷
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ মোট ৩৯টি দল অংশ নিচ্ছে২৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ মহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় তাদের প্রার্থীরা বিএনপি'র ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ গ্রহণ করছে৷
তবে জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ হলেও দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়েই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ বিজেপি'র একমাত্র প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাইকেল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন৷ জোটের অন্য সবা দলের প্রর্থীরা আাওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকেই নির্বাচন করছেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, ‘‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও আশার দিক হলো এবার সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ নির্বাচনকে সেই দিক দিয়ে অংশগ্রহণমূলক বলা যায়৷ যদি সব দল নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে একটা সংকট তৈরি হতে পারত৷ কে সরকারে থাকবে৷ তৃতীয় কোনো শক্তি সুযোগ নেয় কিনা৷ সেই আশঙ্কা কেটে গেছে৷''
কার্জন বলেন, ‘‘আগের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা কম৷ কিন্তু সহিংসতার নতুন একটা মাত্রা দেখা গেছে৷ প্রার্থীদের ওপর হামলা অতীতে এরকম দেখা যায়নি৷ এবার প্রার্থীরা হামলা ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷ আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আমি সন্তুষ্ট নই৷ নির্বাচন কমিশনের অধীনে পুলিশ প্রশাসন যেভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি৷''
বিএনপি দাবি করছে, তফসিল ঘোষণার পর শুক্রবার পর্যন্ত তাদের ওপর ২,৮৯৬টি হামলা হয়েছে৷ ৯ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন ১৩ হাজার৷ অন্ততঃ ১২ জন প্রার্থীর ওপর সরাসরি হামলা হয়েছে৷ ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে৷ ১৬ জন প্রার্থীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ আর শনিবার রাতে আরে এক হাজার জনকে আটক করা হয়েছে৷
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের দাবি, তাদের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগের ৬ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন ৪৪৫ জন৷ তাঁদের গাড়িবহর ও নির্বাচনি কেন্দ্রে ১৭৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫৮টি৷
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- এই আশার মধ্যেও আতঙ্ক এবং আশঙ্কার জায়গা হলো, আমি নিজেও ভোটটি ঠিকমত দিতে পারব কিনা এবং আমার ভোটটি কাউন্ট হবে কিনা৷ নির্বাচনে সহিংসতা এবং আহত নিহত এ পর্যন্ত অন্যবারের তুলনায় কম৷ কিন্তু নতুন দিক হল, পুলিশ সরাসরি একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে পক্ষ নিচ্ছে৷ বিএনপি'র চেয়ারপার্সন কারাগারে আছেন৷ কারাগারে আছেন তাদের আরো ১৭ জন নেতা৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি৷ বিএনপি'র পোস্টার লাগানোর অপরাধেও কারাগারে যেতে হয়েছে৷ আমার কথা হলো নির্বাচনে জিততে গিয়ে দেশের মানুষ এবং দেশ যেন পরাজিত না হয়৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিরোধীদের সন্তুষ্ট করে নির্বাচন করার মত রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি৷ সরকারি দলের প্রভাব সব সময়ই থাকে৷ এবারও তাই হয়েছে৷ তবে আশার কথা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে একটি দলীয় সরকারের অধীনে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷''
তাঁর মতে, ‘‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে মত একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে পারেনা৷ নির্বাচন রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা শ্রেয়৷ এবার যে প্রক্রিয়া শুরু হলো আমি আশা করি একসময় এই প্রক্রিয়ায় সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে৷''
এবারের নির্বাচনে মোট প্রার্থী ১,৮৪৮ জন, তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী ৬৯ জন৷ ৩০০ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ৪০,১৮৩টি৷ মোট ভোটার ১০,৪১,৯০,৪৮০ জন৷ নারী ভোটার ৫,২৫,৪৭,৩২৯ জন৷
নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্যসহ প্রায় আট লাখ পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন৷
নূর খান বলেন, ‘‘নির্বাচনটা দেখার পরই আসলে এ নিয়ে কার্যকর মন্তব্য করা যাবে৷ আমরা আসলে নির্বাচনটা দেখারই অপেক্ষায় আছি৷''