ইসরায়েলের ৬৫ বছর
১৪ মে ২০১৩১৯৪৮ সালের ১৪ মে৷ সেদিন তেল আভিভের একটি মিউজিয়ামে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়৷ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এই অসীম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটির কিছু পুরনো সাদা-কালো আলোকচিত্র, কাঁপা কাঁপা ফিল্ম ফুটেজ আর একটি খরখরে অডিও টেপ ছাড়া আর কিছু পড়ে নেই৷ ছবিগুলিতে দেখা যাচ্ছে প্যালেস্টাইনের ইহুদি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রধান ডেভিড বেন গুরিয়নকে৷ তাঁর মাথার উপর জিওনিজমের প্রতিষ্ঠাতা টেওডোর হেরৎসল-এর প্রতিকৃতি৷ বেন গুরিয়নের বাঁ হাতে স্বাধীনতার ঘোষণা৷
‘‘আমরা ইসরায়েল নামক দেশে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করছি'', আনুষ্ঠানিকভাবে জানান বেন গুরিয়ন৷ পরে তিনি তাঁর দিনলিপিতে লেখেন: ‘‘বৈঠক শেষ হলো আমাদের জাতীয় সংগীত হাতিভকা গেয়ে৷ বাইরে তেল আভিভের রাস্তায় মানুষজন নাচছে৷'' কিন্তু ঐ আনন্দের মুহূর্তেও ছিল আসন্ন যুদ্ধের কালো ছায়া৷
স্বাধীনতা যুদ্ধ
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ব্রিটিশ ম্যানডেট ভুক্ত প্যালেস্টাইনকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, আরবরা যা প্রত্যাখ্যান করেছিল৷ ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইহুদিদের মোট এলাকার অর্ধেকের বেশি প্রদান করা হয়েছিল৷ সেই এলাকায় তখন কি সংখ্যক ইহুদি কিংবা আরবের বাস ছিল, সে পরিসংখ্যান আজও বিতর্কিত৷ কিন্তু বেন গুরিয়ন ইসরায়েলে ইহুদিদের জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার জন্য বিপুল সংখ্যক আরবকে বিতাড়ন করার সিদ্ধান্ত নেন৷ ঐ ফিলিস্তিনিরা – আজ তাদের ফিলিস্তিনিই বলা হচ্ছে – নিকটবর্তী আরব দেশ কিংবা পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপে পলায়ন করে৷ ৫৩০টি ফিলিস্তিনি গ্রাম সে সময় নিশ্চিহ্ন হয়, লুপ্ত হয়ে যায় ১১টি ফিলিস্তিনি শহর৷
‘ছয় দিনের যুদ্ধ'
পশ্চিম তীর কিংবা গাজা স্ট্রিপ সে আমলে ইসরায়েলের দখলে ছিল না৷ কিন্তু ১৯৬৭ সালের ‘ছয় দিনের যুদ্ধের' পর ইসরায়েল ঐ এলাকা দু'টিও নিজের দখলে আনে৷ ৫ থেকে ১০ জুন, এই ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপ ছাড়া গোলান হাইটস দখল করে৷ বিশেষ করে পূর্ব জেরুসালেম ও তথাকথিত ‘উইপিং ওয়াল' পুনরায় ইসরায়েলের হাতে আসাটা ইহুদিদের কাছে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷
বসতি নির্মাণ
অধিকৃত এলাকাগুলিতে শীঘ্রই ইহুদি বসতি নির্মাণ শুরু হয়৷ এবং তা-তে শ্রমদলের নেতৃত্বাধীন সরকারের শুধু সম্মতি নয়, প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সাহায্য ছিল৷ এই বসতিগুলি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার বহির্প্রাকার হিসেবে কাজ করবে, অধিকৃত এলাকাগুলিতে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং এখানে যাতে স্বশাসনের কাঠামো না গড়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে – এই ছিল উদ্দেশ্য৷
১৯৭৯ সালে মিশরের সঙ্গে শান্তি চুক্তি, কিংবা ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা, কিংবা ২০০৫ সালে ইসরায়েলের গাজাস্ট্রিপ থেকে পশ্চাদপসারণ – কিছুই ইসরায়েলের বসতি নির্মাণ নীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি৷ স্বয়ং নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইটঝাক রাবিন অধিকৃত এলাকাগুলিতে ইহুদি বসতির বিরোধী হলেও, সেগুলি খালি করার নির্দেশ দেওয়া সাহস পাননি৷
আজ পশ্চিম তীরে এবং পূর্ব জেরুসালেমে মোট পাঁচ লাখ ইহুদি বাসিন্দা এই সব বসতিতে বাস করছে৷ তাদের মধ্যে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত বহু ইহুদিরা আছে, যারা সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইসরায়েলে আসে৷ মোট দশ লক্ষ রুশি ইহুদি ইসরায়েলে স্থান পেয়েছে৷ ১৯৯১ সালে ইথিওপিয়া থেকে ১৪ হাজার ইহুদিকে ইসরায়েলে আনা হয়৷
ইসরায়েলি-জার্মান সম্পর্ক
ইসরায়েলের সঙ্গে ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে ১৯৬৫ সাল যাবৎ৷ নাৎসি আমলে ইউরোপীয় ইহুদিদের সম্পত্তি দখল ও হত্যার জন্য জার্মানি প্রায় ৩৫০ কোটি মার্ক ক্ষতিপূরণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় – এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৬২ সালে৷ তারও আগে, ১৯৬০ সালের ১৪ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলে জার্মান চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের৷ সাক্ষাতের পর বেন গুরিয়ন সাংবাদিকদের সমীপে বলেন: ‘‘আমি ইসরায়েলি সংসদে বলেছি, আজকের জার্মানি অতীতের জার্মানি নয়৷ আডেনাউয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, আমার এ ধারণা ঠিক৷''
জার্মানি ও ইসরায়েলের মধ্যে আজ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক৷ ইসরায়েলের মিত্রদেশগুলির মধ্যে প্রথমেই জার্মানিকে গণ্য করা হয় – রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক, সব বিচারেই৷ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ২০০৮ সালে ইসরায়েলি ক্নেসেটে প্রদত্ত ভাষণে যেমন বলেছিলেন: ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য জার্মানির একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব আছে৷ ‘‘এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের জাতীয় স্বার্থের অঙ্গ৷ এর অর্থ, জার্মান চ্যান্সেলর হিসাবে আমার কাছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আপোষ চলতে পারে না৷''