ইসলামী ব্যাংকসহ দুই ব্যাংকে পর্যবেক্ষকেরা কী পারবেন?
১৩ ডিসেম্বর ২০২২তবে তা প্রত্যাহার করা হয়েছিলো৷ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নয়, পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করা দরকার৷
ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেও একই সঙ্গে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক আবুল কালামকে৷ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক করা হয়েছে পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের পরিচালক মোতাসিম বিল্লাহকে৷ তারা সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছেন৷
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে:
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানান,"এই দুইটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে৷ তারা ঋণ দেয়ায় নিয়ম মানেনি৷ গ্রাহকেরা আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছিলেন৷ ব্যাংক দুইটিকে নিয়মের মধ্যে রাখা এবং গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷”
তিনি জানান,"পর্যবেক্ষকেরা পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে সভায় ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থী কিছু হলে তারা মতামত দেবেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবেন৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কী না এবিষয়ে তারা প্রতিবেদন দেবেন৷ ”
তিনি বলেন,"এর বাইরে নানা গুজবে ব্যাংকগুলো চাপে আছে৷ তাই আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে৷”
বাংলাদেশ ব্যাংক যতদিন মনে করবে ততদিন ওই দুইটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকেরা কাজ করবেন৷
ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ১৯৯৪ সাল থেকে এই ব্যবস্থা চলে আসছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক যখন প্রয়োজন মনে করে তখন ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বলে জানান তিনি৷
পর্যবেক্ষক যে কারণে:
ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বর মাসে নাবিল গ্রুপ ও মার্টস বিজনেস লাইন নামে দুইটি ভুয়া কোম্পানি খুলে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়৷ স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে তারা ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে জানা যায়, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ তাদের ঋণ পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা হলো ২১৫ কোটি টাকা৷ নিয়ম না মেনে তাদের ঋণ দেয়া হয়েছে৷ ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ তাদের নিয়ন্ত্রণে মোট আটটি ব্যাংক৷
পর্যবেক্ষক নিয়োগ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংককে তারল্য সহায়তার অংশ হিসেবে ৭ ডিসেম্বর চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় ১৪ দিনের জন্য৷ তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও আছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক৷
ঋণ দেয়ায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় গ্রাহকেরা আমানত তুলে নেয়ায় ওই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট হওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটির অধীনে তাদের ওই স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয়৷
এর আগেও ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম ও জঙ্গি অর্থায়নের আশঙ্কায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে, এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ আর ২০২০ সালের মার্চে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
পর্যবেক্ষক কতটা কাজে আসবে?
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যববস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন,"নব্বইয়ের দশকে সাতটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর ওই ব্যাংকগুলো দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে৷ ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিলো রাজনৈতিক প্রভাব, জঙ্গি অর্থায়ন এই বিষয়গুলো দেখতে৷ সেরকম কিছু না পেয়ে হয়তো পর্যবেক্ষক প্রত্যাহার করা হয়৷ কিন্তু নতুন পরিচালনা পর্ষদ আসার পর তারা কী করেছে তা তো বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেনি৷ এখন সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করলেও কোন ব্যাংক কী করছে সেটা দেখার ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাদের৷ তারা তো দেখেনি৷”
তার কথা,"পর্যবেক্ষকও সঠিকভাবে কাজ নাও করতে করতে পারে৷ তাকে ঠিকমত কাজ করতে দেয়া নাও হতে পারে৷ গত বছরও আমরা দেখেছি একজন পর্যবেক্ষক কাজ করতে না পেরে পদত্যাগ করে চলে গেছেন৷ বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকজন বসিয়ে দিয়েছে৷ তাই আসল কথা হলো বাংলদেশ ব্যাংককে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে৷ দায়িত্ব পালন করতে হবে৷”
প্রশাসক নিয়োগ করা উচিত ছিলো:
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন,"ছোটখাটো ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করলে হয়তো কাজ হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সরসরি মনিটর করতে পারে৷ কোনো অনিয়ম হলে তারা তা সরাসরি দেখতে পারে৷ কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের মত বড় এবং প্রভাবশালীদের ব্যাংকে পর্যবেক্ষক কী করবেন! অনেকেরই সুপারিশ ছিলো ইসলামী ব্যাংকসহ একই শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ করা৷ তাহলে তার স্বাক্ষর ছাড়া কিছু হতো না৷ কিন্তু তা তো করা হলো না৷ অনেক নরম ব্যবস্থা নেয়া হলো৷”
তার কথা," আমরা এর আগেও তো দেখেছি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে কাজ হয়নি৷ তারা কাজ করতে পারেনি৷ একটি ব্যাংকের প্রভাবশালী ১৫ জন পরিচালক আর ১০ কর্মকর্তার সামনে পর্যবেক্ষক কি করবেন? তবে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলে আলাদা কথা৷”
পাঁচ ব্যাংকে সমন্বয়ক:
পর্যবেক্ষক ছাড়াও বাংলাদেশের পাঁচটি ব্যাংকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ করা সমন্বয়ক কাজ করছেন৷ এগুলো হলো, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক৷ আরো পাঁচটি ব্যাংককে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে ওইসব ব্যাংকও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
এদিকে মঙ্গলবার হাইকোর্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য রণ হক সিকদার ও তার পরিবারবর্গের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন৷