ঈদ, ঈদের গান এবং নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের জয়রথ
২ মে ২০২২তখন বিশ শতকের চতুর্থ দশক সবে শুরু হয়েছে৷ ভাটিয়ালী, পল্লিগীতি ও ইসলামি গানের শিল্পী হিসেবে পরে বেশি বিখ্যাত হলেও আব্বাসউদ্দীন আহমদ তখনো তত বিখ্যাত নন৷ ১৯৩০ সালে ‘কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো' আর ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়' -এই দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশের সুবাদে যে পরিচিতিটুকু হয়েছিল তা অবশ্য কিছু নজরুল গীতির রেকর্ডের মাধ্যমে অনেকটা বেড়েছে৷ তার গাওয়া নজরুল গীতি ‘বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর', ‘অনেক ছিল বলার যদি সেদিন ভালোবাসতে', ‘গাঙে জোয়ার এলো তুমি ফিরে এলে কই', ‘বন্ধু আজও মনে রে পড়ে আম কুড়ানোর খেলা' তখন ভালোই চলছে৷ একদিন নতুন একটা আইডিয়া এলো তরুণ আব্বাসউদ্দীনের মাথায়৷ কাজী নজরুল ইসলামকে বললেন, ‘‘কাজীদা, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়ালরা যে উর্দু কাওয়ালি গায়, তাদের গান তো শুনি অনেক বিক্রি হয়, বাংলায় এই ধরনের ইসলামি গান দিলে হয় না? আপনি তো জানেন, কিভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ৷ আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান৷''
কাজী নজরুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না৷ গানের বাণিজ্যের দিকটা তিনি কম বোঝেন, যিনি বোঝেন সেই গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দিলেন৷ কথা বললেন আব্বাসউদ্দীন৷ কিন্তু ভগবতী ভট্টাচার্য রাজি হলেন না৷ তখনো সাধারণ মুসলিম পরিবারে সংগীত খুব একটা জায়গা পায়নি৷ মুসলিম শিল্পীরা অবশ্য যদিও গাইতে শুরু করেছেন, কেউ কেউ খুব জনপ্রিয়ও হয়েছেন, তবে তাদের অনেকেই গাইতেন ধর্মীয় পরিচয়টা গোপন করে৷
যেমন কে মল্লিক৷ প্রকৃত নাম মুন্সী মহম্মদ কাশেম৷ কানপুরের সংগীতজ্ঞ আবদুল হাই হাকিমের কাছে সংগীত শিক্ষা নিয়ে তিনি যখন কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রথম গানের রেকর্ড বের করতে চাইলেন, কণ্ঠ শুনে সবাই বলেছিলেন তার গান বাজারে ভালো চলবে৷ প্রথমেই ঠিক হলো তাকে দিয়ে শ্যামা সংগীত গাওয়ানো হবে৷ কিন্তু শ্যমা সংগীত শুনবে তো হিন্দু শ্রোতারা, মুন্সী মহম্মদ কাশেম সেই গান গাইলে তারা হয়ত শুনবে না, তাই শুধু কাশেমের আদ্যাক্ষর কে রেখে নাম দেয়া হলো কে মল্লিক৷ ওই নামেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন বর্ধমানের কুসুম গ্রামের শিল্পী৷
তো বাজারে যখন আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, শ্যামা সংগীত ছাড়া অন্য গান বেশি চলে না, সেসব গান মুসলিম শিল্পীদের কণ্ঠে শোনার মতো শ্রোতা যখন তেমন একটা গড়ে ওঠেনি, তখন আব্বাস উদ্দীন নামের কারো গাওয়া ইসলামি গান তো আরো কম চলার কথা৷ প্রস্তাবটি তাই ‘না, সম্ভব নয়' বলে উড়িয়েই দিলেন ভগবতী ভট্টাচার্য৷
কিন্তু আব্বাসউদ্দীন হাল ছাড়েননি৷ তাঁর মনে হয়েছিল, মুসলিম সমাজ চিরকাল গান-বিমুখ নিশ্চয়ই থাকবে না, একবার স্বাদ পেলে উর্দু কাওয়ালির মতো ইসলামি গানও তারা বারবার শুনবেন, এক সময় অন্য গানের মজাও তারা বুঝতে শুরু করবেন৷
ছয় মাস পর এক দুপুরে আবার গেলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে৷ ভগবতী ভট্টাচার্য সেদিন খোশ মেজাজে৷ চুটিয়ে গল্প করছেন আশ্চর্যময়ী দাসীর সঙ্গে৷ আব্বাস উদ্দীনকে দেখেই ভগবতী বাবু একগাল হেসে বললেন, ‘‘বসুন, বসুন৷'' বসে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আব্বাসউদ্দীন আর দেরি করলেন না, কোনো ভণিতা না করে সরাসরি বললেন, ‘‘সেই যে ইসলামি গানের কথা বলেছিলাম না, একটা এক্সপেরিমেন্টই করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না!''
বাকিটা ইতিহাস৷
আগে ‘না. না' বলে উড়িয়ে দিলেও ভগবতী ভট্টাচার্য সেদিন রাজি হলেন, আব্বাসউদ্দীন ছুটে গেলেন কাজী নজরুল ইসলামের কাছে৷ ‘কাজীদা' ইন্দুবালাকে গান শেখানো বন্ধ করে শুরু করলেন তাঁর জীবনের প্রথম ইসলামী গান লেখা৷ আধ ঘণ্টার মধ্যে গান লেখা শেষ, কিছুক্ষণের মধ্যে সুর করে গেয়েও শোনালেন সেই গান:
‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।''
চারদিন পর দুটি গান নিয়ে বের হলো বাংলা ইসলামি গানের প্রথম রেকর্ড৷ সে আমলে বাংলা গানে বাদ্যযন্ত্র বলতে ছিল শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা৷ অল্প সময়েই গান রেকর্ড করা শেষ হলো৷ আব্বাসউদ্দীন তো মহাখুশি৷ যাক, এতদিনে ইসলামি গান গাওয়া হলো, সেই গানের রেকর্ডও হলো! ক'দিন বাদেই ঈদ৷ তাই খুশিমনে কলকাতা থেকে ঈদ করতে চলে গেলেন কুচবিহারের গ্রামের বাড়িতে৷
ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরে কলকাতায় ফিরে অফিসে যাওয়ার ট্রামে উঠতেই আব্বাসউদ্দীনের কানে এলো ‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'৷ এক তরুণ বসে বসে গুনগুনিয়ে গাইছে তার গান! অফিস শেষে গড়ের মাঠে বেড়াতে গেলেন, সেখানেও ছেলেরা বসে গাইছে, ‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...৷'' ঈদের সময় যে গান বাজারে আসার কথা, সেই গান এত অল্প সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরছে! ইসলামি গান এই ক'দিনেই সবার মুখে মুখে! বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ বিষয়টা বুঝতে আব্বাসউদ্দীন এবার ছুটে গেলেন ধর্মতলার সেনোলা রেকর্ড কোম্পানিতে৷ সেনোলার মালিক বিভূতিভূষণ সেন তাঁকে দেখে কী করেছিলেন তার বর্ণনা আব্বাস উদ্দীন ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পীজীবনের কথা' গ্রন্থে নিজেই লিখেছেন, ‘‘বিভূতিদার দোকানে গেলাম৷ আমাকে দেখে তিনি একদম জড়িয়ে ধরলেন৷ সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, ‘খাও৷' আমার গান দুটো এবং আর্টপেপারে ছাপানো আমার বিরাট ছবির একটা বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘‘বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বিলি করে দিয়ো৷ আমি সত্তর-আশি হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি৷ আর এই দেখো দুই হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার৷''
বাংলা ইসলামি গানের প্রথম রেকর্ড তো সুপার-ডুপার হিট! গানের শ্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা না করলে কি চলে? ছুটে গেলেন তাঁর বাড়ি৷ কাজিদা তখন রিহার্সেল রুমে দাবা খেলায় ব্যস্ত৷ দাবার বোর্ড নিয়ে বসলে তাঁর আবার জগৎ-সংসারের কথা মনে থাকে না৷ কিন্তু ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পীজীবনের কথা' (মুস্তফা জামান আব্বাসী সম্পাদিত) গ্রন্থে আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন তাঁর কণ্ঠ শুনেই নাকি সেদিন ছুটে এসেছিলেন নজরুল, ‘‘আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে...' আর বলতে দিলাম না, তাঁর পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলাম৷ ভগবতীবাবুকে বললাম, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন? তিনি বললেন, ‘এবার তাহলে আরো ক'খানা এই ধরনের গান...' খোদাকে দিলাম কোটি ধন্যবাদ৷''
তারপর ইসলামি গান চলবে কিনা তা নিয়ে আর কাউকে ভাবতে হয়নি৷ বরং ইসলামি গানের বাজার এত রমরমা হলো যে গাওয়ানোর মতো এত মুসলিম শিল্পী পাওয়াই দায়৷ আব্বাস উদ্দীন একা আর কত গাইবেন? প্রায় প্রতি মাসেই বাজারে আসছে তাঁর রেকর্ড৷ একজন এত গাইলে একসময় তো একঘেয়েমীও এসে যায়৷ তাই হিন্দু শিল্পীদেরও ইসলামি গান গাইতে হলো মুসলিমদের নাম নিয়ে৷ ধীরেন দাস হয়ে গেলেন গণি মিঞা, চিত্ত রায় হলেন দেলোয়ার হোসেন, গিরীন চক্রবর্তী হলেন সোনা মিঞা, আশ্চর্যময়ী, হরিমতীরা হলেন সকিনা বেগম, আমিনা বেগম৷
নয় দশক পর অবশ্য মুন্সী মহম্মদ কাশেমকে কে মল্লিক বা ধীরেন দাস, আশ্চর্যময়ীদের গণি মিঞা বা সকিনা বেগম হয়ে শ্রোতার কাছে আসার কথা ভাবতেও হয় না৷