একাত্তরের বিজয় দিবসে ২০২৪ মেলানোর চেষ্টা
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। সেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘বিজয় র্যালি' হয় সকালেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে আবার তা সেখানেই ফিরে আসে। র্যালির মূল ব্যানারে লেখা ছিল,"আজাদী-৪৭, মুক্তিযুদ্ধ-৭১, স্বাধীনতা-২৪”। আর ব্যানারের নিচে ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ দেশভাগের সময়কার নেতাদের ছবি।
র্যালির বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ', ‘ধর্ম. বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে, ৭১ এসে ২৪-এ মিশে'' প্রভৃতি লেখা দেখা যায়। এছাড়াও মিছিলে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ', ‘একাত্তরের শহীদেরা, লও লও লও সালাম', ‘গোলামি না আজাদী, আজাদী আজাদী', ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা', ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ' প্রভৃতি স্লোগান দেওয়া হয়।
আর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘আজকের এই দিনে আমরা স্মরণ করছি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সব শহীদকে। সেই সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদেরও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয় এলেও সেই স্বাধীনতা অরক্ষিত ছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছে।''
আর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমাদের প্রজন্মের জন্য এই বিজয় দিবসটাই প্রকৃত বিজয় দিবস। এর আগে আমরা বিজয় কী উদযাপন করবো, স্বাধীনভাবে কথাই বলতে পারতাম না। এটা আমরা পেয়েছি জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদেরও রক্তের বিনিময়ে।”
তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর বলেছেন, "আমরা প্রায় সব সময় ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করি এবং করি। যখন যে ক্ষমতাবান থাকে, সে ইতিহাসের মহানায়ক সাজতে চায়। কিন্তু সেটা সত্য নয়। অতীতকে ভুলে গেলে বর্তমান যেমন নিপতিত হবে, ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার।'' তিনি আরো বলেন, ‘‘স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে হবে, স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের মূল্য দিতে হবে, শহীদদের মূল্য দিতে হবে, স্বাধীনতার নেতৃবৃন্দের মূল্য দিতে হবে। তাদের অস্বীকার করে আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা কোনোমতেই উচিত নয়। চেঙ্গিস খানেরা মিসরের সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য মিশরকে জ্বালিয়েছিল। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পোড়ানো সবচেয়ে বড় অন্যায় হয়েছে।''
বাংলাদেশ জাতীয়বাবাদী দল (বিএনপি) সারা দেশে বিজয় র্যালি করেছে। তারা এই দিনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেছে।
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গিয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। বিদেশি কূটনীতিকরা। বিভন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, সাধারণ মানুষ।তবে সেখানে আগের মতো মুক্তিযোদ্ধারা তেমন যাননি।
সকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান পরাগ। তিনি বলেন, ‘‘এবার প্রধান উপদেষ্টাই সঙ্গে করে ১৭-১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা বলার সুযোগ ছিল না। প্রতিবছর যেভাবে আলাদা করে মুক্তিয়োদ্ধারা ব্যানার নিয়ে যেতেন, এবার তেমন দেখিনি। আমরা পরে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে পাইনি।”
"সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ভালোই ছিল। তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় কম। সাধারণ মানুষকে স্মৃতিসৌধে ঢুকতে দেয়া হয় বেশ দেরিতে।”
প্রধান উপদেষ্টা বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তিনি ২০২৪-এর গণআন্দোলনের কথাই বেশি বলেছেন। আর ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের র্যালি, স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আটক
জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও বিজয় দিবসে র্যালি বের করেছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে।
আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে সাভার স্থানীয় আওয়ামী লীগের আট জন নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন।
এক মুক্তিযোদ্ধার চোখে বিজয় দিবস
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যারা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাদের একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা। তিনি এখন বসবাস করেন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলায়। তিনি বলেন," উপজেলা প্রশাসন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার দিয়েছে। কিন্তু ইউএনও সাহেব আমাদের আগেই বলে দিয়েছেন এখানে জয় বাংলা বা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলা যাবে না। ওগুলো দলীয় স্লোগান।”
"এবার পার্থক্য চোখে পড়েছে। কেউই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেননি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। কিন্তু ইতিহাস থেকে তার নাম মোছা যাবে না। এটা তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে। আসলে যারা ক্ষমতায় আসে, তারা অন্যদের অবদানকে মুছে ফেলতে চায়। আওয়ামী লীগও জিয়াউর রহমান সাহেবের নাম মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছিল,” বলেন তিনি।
তার কথা, " একটি জাতির জীবনে স্বাধীনতার চেয়ে বড় কোনো অর্জন নেই। সেই অর্জনের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। কিন্তু এবার দেখছি একই মাত্রায় এই বিজয় দিবসেই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে তুলনা করা হচ্ছে। এটা ঠিক না। আর বঙ্গবন্ধু শুধু বঙালির না, সারা বিশ্বের নেতা। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে তার তুলনা করলে চলবে না। তিনি আলাদা। তিনি কোনো দলের না, তিনি সবার।”
রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, " সরকারের দিক থেকেই এবার বিজয় দিবস উদযাপনে নানা ব্যত্যয় দেখছিলাম। বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ বন্ধ করা হয়েছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে ছিল অব্যবস্থাপনা। আর তথ্য অধিদপ্তর থেকে বিজয় দিবসের যে পোস্টার ছাপা হয়েছে তার সমালোচনা আমি আগেই করেছি। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের বীর নূর হোসেন। ২০২৪-এর বীর আবু সাঈদ। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে। এবার আবু সাঈদের ছবি দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় বিজয় দিবসের পোস্টার করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে মহান মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা হয়েছে।”
তার কথা," এবার আমরা দেখেছি অনেকের ছবি সামনে আনা হয়েছে। নিশ্চয়ই তাদের অনেকের অবদান আছে। কিন্তু আরো যাদের অবদান আছে, তাদের ছবি সামনে আনা হয়নি। এভাবে নতুন করে ইতিহাস তৈরি করা যায় না। আর প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সামান্য দু-একটি কথা বলেছেন। অনেক বলেছেন তার ২০২৪-এর সহযোগীদের নিয়ে। এটা তো বিজয় দিবসে হতে পারে না। আমরা এবার দেখেছি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও বিজয় র্যালি করে হুঙ্কার দিয়েছে। আমার মনে হয় দেশের জনগণকে আরেকবার জেগে উঠতে হবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।”
সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেও অংশ নিয়েছেন। তার কথা,"একটা গণঅভ্যুত্থ্যানের পর যে আবেগ আর উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস উদযাপনের কথা ছিল, তা কিন্তু হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে রিসেট বাটনের কথা বলেছিলেন, এবার বিজয় দিবসে তার প্রতিফলন দেখেছি।”
তার মতে, " ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে, সাত বীর শ্রেষ্ঠ, স্বাধীনতার ঘোষক অথবা পাঠক জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কীভাবে নির্মাণ করবেন। তাদের নাম তো উচ্চারিত হচ্ছে না। তাদের বাদ দিয়ে যাদের ছবি নিয়ে আসছেন, তাদের কারো কারো ভূমিকা আছে জাতিরাষ্ট্র গঠনে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় রিসেট বাটনের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস বিস্মৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এটা আসলে সম্ভব নয়। এটা আগুন নিয়ে খেলা।”
তরুণ প্রজন্ম যা দেখছে
কাজী স্বনক দীনেশ পোস্ট গ্রাজুয়েটের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। তার কথা, ‘‘আমি স্বাভাবিভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি। দীর্ঘ ২৩-২৪ বছরের লড়াইয়ের সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন হই। এটা আমাদের স্বাধীনতা, ভাষা , আত্মপরিচয়ের বিষয়। এর জন্য আমাদের চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ”
"এবার আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪-এর আন্দোলনের একটা তুলনা করার প্রবণতা। আমি নিজেও এই আন্দোলনে ছিলাম। ২৪-এর আন্দোলনের অবশ্যই একটি জায়গা আছে। কিন্তু তার সঙ্গে তো আমি মুক্তিযুদ্ধকে তুলনা করতে পারবো না। কারণ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আর ২০২৪-এ আমরা দুর্নীতি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। দুইটা এক নয়। তুলনা করা ঠিক নয়। যে যার অবস্থানে থাকবে।”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নিকিতা আজম বলেন,"এবার আমি ক্যাম্পাসের কথা বলতে পারবো। আগে সব দলের ছাত্র সংগঠন বিজয় দিবস উদযাপন করতো, এখন আওয়ামী লীগ তো চলে গেছে। এবার দেখলাম ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্র শিবির বিজয় দিবস উদযাপন করছে।”
"এবার আমি দেখলাম এত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে মুখোমুখি করে তুলনা করার প্রবণতা। এটার কোনো মানে হয় না। এখানে বৃটিশরা শাসন করেছে। পাকিস্তানিরা করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আর ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আলাদা একটা প্রেক্ষাপট আছে। বিজয় দিবস আমাদের ১৬ ডিসেম্বর। আর ২০২৪-এর বিজয় দিবস আমার কাছে ৫ আগস্ট। এই দুইটিকে তুলনা করা। বা কোনটা বেশি কোনটা কম সেটা বিচার করা ঠিক না। দুইটা আলাদা।”