এক কারাগারে চার আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন
১০ ডিসেম্বর ২০২৪মানবাধিকার কর্মী এবং জাতীয় গুম কমিশনের সদস্য নূর খান চার আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন৷
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস৷ এই দিনে কথা হলো নূর খানের সঙ্গে৷ কথা হলো বগুড়া কারাগারে মারা যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও৷
আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম ওরফে রতনের তার স্ত্রী শাহিদা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মনে হয় কিছু করেই মেরে ফেলেছে৷ তা না হলে (এত অল্প সময়ে) এতগুলো মানুষ মরবে কেন?''
সর্বশেষ সোমবার সকাল ১০টার দিকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও দুর্গাহাটা ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মতিন ওরফে মিঠু(৬৫)৷ তিনি ওই ইউনিয়নের একাধিকবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন৷ গত ২৪ আগস্ট তাকে আটক করা হয়৷
রবিবার দিবাগত রাতে বগুড়া জেলা কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)-এ ভর্তি করা হয়৷ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কারাগার থেকে তাকে হাসপাতালে আনা হয়৷ সকালে তিনি মারা যান৷''
আব্দুল মতিনের ভাইয়ের ছেলে শান্ত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার চাচার বয়স হয়েছিল৷ তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নাই৷''
এ নিয়ে গত ১১ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯ দিনে বগুড়া কারাগারে বন্দি থাকা চারজন আওয়ামী লীগ নেতা কথিত ‘হৃদরোগে আক্রান্ত' হয়ে মারা গেলেন৷ এর আগে গত ২৬ নভেম্বর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ওরফে ঝুনু (৫৭) কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান৷ ঠিক একদিন আগে, অর্থাৎ, ২৫ নভেম্বর মারা যান শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুল লতিফ (৬৭)৷ এর দু সপ্তাহ আগে, অর্থাৎ, ১১ নভেম্বর কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে রতন (৫৮)৷
এক কারাগারে ২৯ দিনে চারজন, চার মাসে ছয়জন
বগুড়া জেলা কারাগারের জেল সুপার ফারুক আহমেদ মাত্র মাত্র ২৯ দিনে চার জনের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, ‘‘গত এক মাসে চার জনের মৃত্যু হলেও ৫ আগস্টের পর আটক মোট ছয় জন মারা গেছেন৷ অসুস্থ অবস্থায় কারা হাসপাতালে এখনো দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা চিকিৎসাধীন আছেন৷ যারা মারা গেছেন তারা সবাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন৷ তাদের প্রত্যেকের ময়না তদন্ত হয়েছে এবং থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে৷ কোনো নির্যাতন বা আমাদের অবহেলায় কেউ মারা যাননি৷ তাদের সবাই বয়স্ক এবং নানা রোগে ভুগছিলেন৷ তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হামলা ও মারামরিসহ নানা অভিযোগে মামলা আছে৷''
দুর্গাহাটা ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মতিন ওরফে মিঠুর মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘যেদিন রাতে তিনি অসুস্থ হন, সেদিন বিকালেও তার প্রেসার মাপা হয়েছে৷ হার্টবিট স্বাভাবিক ছিল৷ তবে তিনি প্রেসারের রোগী ছিলেন, বাল্কি ছিলেন৷ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন৷''
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ওরফে ঝুনু (৫৭) গত ২৬ নভেম্বর কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান৷ তার মৃত্যু সম্পর্কে জেল সুপার বলেন, ‘‘তিনি গোসলের পর হার্ট অ্যাটাক করে পড়ে যান৷ সাথে সাথে মারা যান৷''
‘তার হার্টের কোনো রোগ ছিল না'
তার স্ত্রী মাহবুবা মঞ্জুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তিনি কী কারণে মারা গেলেন বুঝতে পারছি না৷ তার হার্টের কোনো রোগ ছিল না৷ কারা কর্র্তৃপক্ষ বলছে, তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন৷ আমরা কিছু ভাবতে পারছি না৷ এখন যা পরিবেশ-পরিস্থিতি তাতে আমরা অভিযোগ করার কথা চিন্তা করতে পারছি না৷ এখন আমাদের টিকে থাকাই কষ্ট৷''
২৫ নভেম্বর মারা যান শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুল লতিফ (৬৭)৷ তার ছেলে শাহরিয়ার কবির বলেছেন, বাবার মৃত্যুর বিষয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে৷ আমাদের কোনো অভিযোগ নাই৷''
১১ নভেম্বর কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে রতন (৫৮)৷ তার স্ত্রী শাহিদা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বলেছে তো হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে৷ এখন কী কারণে মারা গেছে কীভাবে বলবো৷ পুলিশ বলেছে, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেড় মাস পরে পাওয়া যাবে- তখন মৃত্যুর কারণ জানা যাবে৷ এখন কী রিপোর্ট দেয় না, না দেয় কী জানি৷ আমার মনে হয় কিছু করেই মেরে ফেলেছে৷ তা না হলে (এত কম সময়ে) এতগুলো মানুষ মরবে কেন?''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সে মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আমি কারাগারে তার সাথে দেখা করেছি৷ সে তখন বলেছে, তার বুক ব্যথা, শরীরে বিষ-ব্যথা৷ হাসপাতাল থেকে ঠিকমতো ওষুধ , চিকিৎসা দেয় না৷ তার ডয়াবেটিস ছিল৷''
বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে রতনের মৃত্যু সম্পর্কে জেল সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘‘তিনি মারা যাওয়ার আগে দুই-তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন৷''
নওগাঁ কারাগারে এক সপ্তাহে সাত জনের মৃত্যু?
বগুড়া জেলা কারাগারের জেল সুপার ফারুক আহমেদ আরো বলেন, ‘‘যারা মারা গেছেন তারা সবাই বয়স্ক৷ সবার বয়স ৬০ বছরের উপরে৷ এমনিতেই তারা নানা রোগে ভুগছিলেন৷ মৃত্যুর উপরে তো কারো হাত নেই৷'' এ সময় তিনি জানান, তার আগের কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুহার আরো বেশি ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি এর আগে নওগাঁ ছিলাম৷ সেখানকার কারাগারেও এক সপ্তাহে সাত জন মারা গেছেন৷''
ওই সাতজনের মৃত্যুকাল সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি৷
জেল সুপার জানান, ‘‘৫ আগস্টের পর বগুড়া কারাগারে দুইশ'রও বেশি আওয়ামী লীগের নেতা আটক ছিলেন৷ এখন ৫০ জনের মতো আছেন৷ বাকিরা জামিনে বের হয়ে গেছেন৷''
‘ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই কী ধরনের মৃত্যু'
মাত্র ২৯ দিনে চার আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু সম্পর্কে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ তবে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি৷ ডিউটি অফিসার সাব ইন্সপেক্টর মেহেদুল ইসলাম বলেন, ‘‘কারাগারে মৃত্যু হলে সাধারণত অপমৃত্যুর মামলা হয়৷ ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই সেটা কী ধরনের মৃত্যু৷ কারাগার থেকে বলা হয়েছে তাদের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে৷''
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘এটা খুব দুর্ভাগ্যজনকে যে, যখন যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের অনেকেই কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন৷ এই মৃত্যুগুলো নিয়ে আসলে একটা সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার৷ এবং একই মাসে আওয়ামী লীগের চারজন নেতা একটি জেলা কারাগারে ইন্তেকাল করেন এটাকে সন্দেহের চোখে দেখাটাই স্বাভাবিক৷''