এক নাৎসির নাতনির বই
২৪ অক্টোবর ২০১৩অবিশ্বাস্য ইতিহাস
‘‘অনেকের হয়তো বিশ্বাসই হবে না, এই ইতিহাস কোনো বানানো গল্প নয়,'' বলেন জেনিফার৷ আসলেও অবিশ্বাস্য তাঁর কাহিনি৷ মাত্র পাঁচ বছর আগে জানতে পারেন জেনিফার, তাঁর নানা একজন কুখ্যাত নাৎসি ছিলেন৷ নাম তার আমোন গ্যোট৷ পোল্যান্ডের ক্রাকাউ-এর কাছে পুয়াশোফ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কমান্ডার হিসাবে কাজ করতেন৷
আমোন গ্যোট-এর নামটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে বিশেষ করে স্টিভেন স্পিলবার্গ চলচ্চিত্র ‘শিন্ডলার্স লিস্ট' মুক্তি পাওয়ার পর৷ সত্যি ঘটনা নিয়ে নির্মিত এই ছবিতে ১৯৩৩ সালের দুই পুরুষের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে৷ একজন আমোন গ্যোট, যিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে অসংখ্য ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী৷ অন্যজন অস্কার শিন্ডলার, যিনি শ্রমক্যাম্প থেকে বের করে নিজের কারখানায় কাজ দিয়ে কয়েকশ মানুষকে রক্ষা করেছেন৷ শিন্ডলারকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলে৷ আমোন গ্যোট-কে ১৯৪৬ সালে পোল্যান্ডে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে৷ একই বয়সি দুই জার্মান৷ কিন্তু দুইজন যেন দুই মেরুর মানুষ৷
পালক পরিবারে বড় হন জেনিফার
জেনিফার এক পালক পরিবারে বড় হন তিনি৷ নিজের বাবা নাইজেরিয়ান৷ মা জার্মান৷ গায়ের রঙ কালো বলে বর্ণবৈষম্যের অভিজ্ঞতাও কম হয়নি তাঁর৷ ‘‘ছোটবেলায় আমার গায়ের রঙের জন্য নানা রকম কথা শুনতে হতো৷ যা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিতো,'' ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানান জেনিফার৷ স্কুল শেষ করে পড়াশোনা করেন তিনি ইসরায়েলে৷ সেখানে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়৷ তাঁদেরকে গ্রন্থপাঠ করে শোনাতেন জেনিফার৷ জার্মান ভাষায়৷ তবে তাঁকে দেখে জার্মান বলে মনে হতো না বলে স্বস্তি বোধ করতেন তিনি৷ কৃষ্ণকায় এই নারী এক নাৎসি অপরাধীর নাতনি, সেটা ইসরায়েলে কেউ হয়ত ভাবতেই পারবে না৷
অজানা ইতিহাস
জেনিফার নিজেও অনেকদিন তাঁর নিজের পারিবারিক ইতিহাস জানতেন না৷ ছোটবেলায় এক পালক পরিবারে আসেন৷ প্রথম দিকে নিজের মা ও নানির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো৷ এরপর যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ ৩৮ বছর বয়সে হঠাৎ করে একটি বই হাতে আসে তাঁর৷ মলাটে মায়ের ছবি দেখে চিনতে পারেন তিনি৷ বইটি ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কমান্ডার আমন গ্যোট ও তার মেয়েকে নিয়ে লেখা৷ জেনিফারের মা৷ আঁতকে ওঠেন তিনি৷ কী করে এটা সম্ভব?
অবশেষে সাংবাদিক নিকোলা সেলমায়ার-এর সঙ্গে মিলে এই সম্পর্কে লেখার সিদ্ধান্ত নেন জেনিফার৷ সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে বইটি৷ শিরোনাম ‘মাই গ্র্যান্ডমাদার উড হ্যাভ শট মি'৷
জেনিফারের নিজের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থে৷ নিজের পরিচিতি খুঁজেছেন তিনি৷ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নীরবতা, তার ফলাফল এসবও প্রকাশ পেয়েছে বইতে৷
‘‘তোমরা তোমাদের অতীতের সঙ্গে বোঝাপড়া কর৷''এইভাবে যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম বারবার আগের প্রজন্মকে আহ্বান জানিয়েছে, যারা নাৎসি আমলটা সরাসরি দেখেছে৷
‘‘কিন্তু নিজের নানা, দাদার সে সময়ে কী ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কেও অনেকে জানেন না,'' লিখেছেন সাংবাদিক নিকোলা সেলমায়ার৷
উভয় সংকট
নাৎসি অপরাধীদের সন্তানরা অনেক সময় দারুণ এক উভয় সংকটে ভোগেন৷ একদিকে তাঁরা বাবাকে প্রশংসার চোখে দেখতে চান, অন্যদিকে প্রচণ্ড ঘৃণা অনুভব করেন৷ একটা অপরাধবোধ ঘুরপাক খেতে থাকে তাঁদের মাথায়৷ অতীতের সম্মুখীন হতে পারলে, মোকাবিলা করতে পারলেই কেবল এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷
‘‘আমোন গ্যোট-কে বলা যায় মন্দের প্রতীক৷ তাই তার কাছ থেকে দূরত্ব নেওয়া সহজ৷ বলা যায়, আমি অন্যরকম,'' বলেন জেনিফার৷ ‘‘কিন্তু মানুষ শুধু ভাল ও মন্দ নয়৷ এর মধ্যে নানা স্তর রয়েছে৷ এই পার্থক্যবোধ থাকাটা খুব জরুরি৷''
বোঝাপড়া করা
জেনিফার পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া করছেন৷ নানির ছবি দেখছেন, চিন্তভাবনা করছেন তাঁকে নিয়ে৷ যিনি আমোন গ্যোট-এর সঙ্গে কনসেনট্টেশন ক্যাম্পের ভিলায় বসবাস করতেন৷
মাঝে মাঝে ক্রাকাউতে যান সাহসী এই নারী, যেখানে তাঁর নানা ভয়ঙ্কর অপরাধটি করেছিলেন৷ সেই সময়ের সাক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন৷ নাৎসিদের সম্পর্কে বইপত্র পড়েন৷ কথা বলেন মনস্তত্ত্ববিদদের সঙ্গে৷ ‘‘সাধারণত মনে করা হয় কোনো কিছু সম্পর্কে বলা না হলেই বুঝি তার কোনো প্রভাবও পড়বে না জীবনে৷ কিন্তু আমার ক্ষেত্রে নীরবতা ধ্বংসাত্মক হয়েছিল,'' বলেন জেনিফার৷
সারা জীবন ডিপ্রেশনে ভুগেছেন তিনি৷ আজ কিন্তু বেশ ভাল বোধ করছেন৷ ‘‘নিজের পরিচিতির জন্য শেকড় জানাটা খুব জরুরি৷ প্রতিটা মানুষেরই এই আকাঙ্খা রয়েছে৷''
এতদিন তাঁর জার্মান পরিবার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন জেনিফার৷ ভবিষ্যতে আফ্রিকাকেও জানার ইচ্ছা আছে তাঁর৷ ইচ্ছা আছে নাইজেরিয়ায় যাওয়ার৷ বাবার দেশে৷