এমন এইচএসসিতেও পাস ৭৭.৭৮%, পাসহীন প্রতিষ্ঠান ৬৫!
১৫ অক্টোবর ২০২৪পরীক্ষার্থীদের কেউ পাস করেননি এমন সাধারণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছর ছিল ৪১টি, এবার হয়েছে ৬৫টি।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১১ লাখ ৩১ হাজার ১১৮ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন আট লাখ ৫৪ হাজার ৬৪৪ জন। গড় পাসের হার ৭৫.৫৬ শতাংশ। গতবার গড় পাসের হার ছিল ৭৬.৯ শতাংশ। এবার ৯টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, যা গতবার ছিল ৭৮ হাজার ৫২১ জন।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ৮৫ হাজার ৫৫৮ শিক্ষার্থী। পাশের হার ৯৩.৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯ হাজার ৬১৩ শিক্ষার্থী।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৮.৯ শতাংশ। এই বোর্ডে মোট এক লাখ ১৪ হাজার ৩৮২ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন চার হাজার ৯২২ জন।
এবার এইচএসসি ও সমমানের ১১ টি বোর্ডের পরীক্ষায় সারা দেশে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী। সে হিসেবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ হাজার ৫৪৬ জন, যা শতকরা হিসাবে ৬৩.৩০ শতাংশ প্রায়।
১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষা দিয়েছেন ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। মোট উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন। পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ। তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হবেন। এখন প্রশ্ন হলো, তারা সবাই উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবেন কিনা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে তাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যপ্ত আসন আছে কিনা।
আসন আছে, মান নাই
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, বাংলাদেশে সরকারি ও কেসরকারি পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ১৩ লাখের মতো আসন আছে। সেই হিসাবে আসনের কোনো সংকট নাই। তবে ভালো প্রতিষ্ঠানে আসনের অভাব আছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তাই তাদের কাঙ্খিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট আসন ৫৬ হজার ৮৮৬টি, সরকারি মেডিকেলে কলেজে পাঁচ হাজার। এই আসনগুলোতেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন আছে আট হাজার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখ ২০ হাজার। সবচেয়ে বেশি আসন আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে, আট লাখ। আর উন্মুক্ত বিশ্বদ্যিালয়ে আছে ৯০ হাজার ৫৯৩টি। এর বাইরেও উচ্চ শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা পর্যায়ে এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে আসন আছে।
ইউজিসির একজন পরিচালক বলেন," প্রতিবছরই আসন বাড়ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখের মতো আসন খালি থাকে। আর প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যায়। আসলে আসন সংকট না থাকলেও উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো প্রকিষ্ঠানের অভাব আছে।”
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তঃ শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যত শিক্ষার্থী পাস করেছেন, উচ্চ শিক্ষার জন্য তার চেয়ে হয়ত বেশি আসন আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো ভর্তি হতে চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ও মেডিকেলে। সেখানে তো এক লাখ আসনও নেই। আর ভালো কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু সেখানে পড়ার আর্থিক সক্ষমতা তো অনেকেরই নেই। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে একটি উচ্চ শিক্ষার সনদ নেয়ার জন্য।”
তিনি এবার পাসের হার কমা ও জিপিএ-৫ বেশি পাওয়ার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন," আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। এগুলো প্রধানত ঐচ্ছিক বিষয় ছিল। এসএসসির রেজাল্টের ওপর তাদের ম্যাপিং করা হয়েছে। অনেকেরই এসএসসিতে সায়েন্স ছিল। এইচএসসিতে আর্টস বা কমার্স নিয়েছে। কিন্তু আগে বিজ্ঞানের কারণে ম্যাপিংয়ে তারা নাম্বার বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে এইচএসসিতে ইংরেজি ও আইসিটিতে বেশি ফেল করে। এই দুইটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এখানে ম্যাপিংয়ের সুবিধা পায়নি তারা। ফলে ফেল একটু বেড়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান মনে করেন, " এবার এই মূল্যায়ন পদ্ধতি সঠিক হয়নি। এটা ত্রুটিপূর্ণ। আসলে ছয়টি পরীক্ষা বাতিলের কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। তারপরও আরো অনেক বিকল্প পদ্ধতি ছিল যার মাধ্যমে মূল্যায়ণ করা যেতো । কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় এবার হয়তো মেধার মূল্যায়ণ হবে। ”
তার কথা, "উচ্চ শিক্ষার জন্য কত আসন আছে, সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো উচ্চ শিক্ষা কার প্রয়োজন, কেন প্রয়োজন। বেকার তৈরির কারখানা করে কোনো লাভ নেই। সার্টিফিকেট সর্বস্ব উচ্চ শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নাই। আমাদের দরকার কর্ম উপযোগী শিক্ষা। সেটা হচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে।''
যেসব কলেজ থেকে কেউ পাস করেনি
লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার গন্ধমারুয়া স্কুল এন্ড কলেজের আট শিক্ষার্থী এবার এইচসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন । কিন্তু কেউই পাস করেননি। এই কলেজের অধ্যক্ষ আখলাকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসলে এবার রেগুলার ছাত্র ছিল তিনজন। আর পাঁচ জন আগের বছরের ফেল করা। ফলে কেউ পাস করতে পারেনি। আর গতবার ১৮ জন পরীক্ষা দেয়, পাসের হার ছিল ৪০ শতাংশ।”
তিনি জানান, ২০১২ সাল থেকে তারা কলেজ সেকশন শুরু করেন। আটজন শিক্ষক আছেন। শুধু আর্টস বিষয়ে এই কলেজে পড়ানো হয়। গ্রামের মধ্যে হওয়ায় ছাত্রও তেমন পাওয়া যায়না। কলেজটি এমপিওভুক্ত নয়। শুধু পাঠদানের অনুমতি আছে। শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়ে তিনি বলেন," শিক্ষকদের মান ভালোই আছে, তবে মান সম্পন্ন ছাত্র পাওয়া যায় না।”
এ বছর এইরকম ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এইসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যা কম। এক থেকে সর্বোচ্চ ১০ জন। আর স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত নয়। বোর্ড থেকে পাঠদানের অনুমতিই শুধু পেয়েছে তারা।
এরকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো ফেনী সদরের বেগম শামসুন্নাহার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেখান থেকে চার জন পরীক্ষার্থী অংশ নিলেও কেউ পাস করতে পারেনি। কলেজটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মো. রাহাত হোসেন বলেন, " আসলে চারজনই আইসিটিতে ফেল করেছে। আমাদের এই বিষয়ে কোনো শিক্ষক ছিল না। গত বছর ২১ জন পরীক্ষা দিয়েছিল, তার মধ্যে ১৭ জন পাস করে। ২০১৪ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারই এইরকম বিপর্যয় হলো।”
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তঃ শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসলে এইসব কলেজ নানা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পারিবারিক ও রাজনৈতিক কারণেও অনেক কলেজ হয়েছে। তারা বোর্ড থেকে শুধু পাঠদানের অনুমাত নিয়েছে। এসব কলেজের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো। তদন্ত করে দেখবো। তাদের পাঠদানের অনুমতি বাতিল করবো।”
"এরকম অখ্যাত, কুখ্যাত প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহরেও আছে। গত বছর ঢাকায় এইরকম চারটি কলেজ থেকে কেউ পাস না করায় এক বছর মানোন্নয়নের সময় দিয়ে তারপরও মান উন্নয়ন না হওয়ায় তাদের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, "আসলে শিক্ষার নানা অপব্যহার হওয়ায় এই ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বাড়ছে।”