‘বিচার না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে’
৩০ অক্টোবর ২০২০বৃহস্পতিবার পাটগ্রামের বুড়িমারিতে আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের নামাজের মধ্যে আবু ইউনূস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী ওরফে জুয়েলকে পিটিয়ে মেরে পুড়িয়ে দেয়া হয়। নিহতের ভাই আক্কাস মোহাম্মদ মাহমুদুন্নবী জানান, তারা সবাই রংপুরে থাকেন। স্কুলের চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার পর ইউনূস গত এক বছর ধরে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। বুধবার ফজরের নামাজের আগে তিনি রংপুরের বাসা থেকে বের হয়ে যান। এভাবে প্রায়ই কাউকে না বলে তিনি বাসা থেকে চলে যেতেন আবার নিজেই ফিরে আসতেন। বৃহস্পতিবার রাতে তার পরিবারের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে হত্যার ঘটনা জানতে পারেন। আক্কাস বলেন, ‘‘আমরা ভাই নিয়মিত নামাজ- রোজা করতেন।’’
কী ঘটেছিল?
পাট গ্রামের বুড়িমারি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি দোতলা। এই মসজিদ থেকেই ঘটনার শুরু। মসজিদের খাদেম জাবেদ আলী বলেন, ‘‘দুই জন লোক আসেন। তাদের মধ্যে একজন আসরের নামামের পর আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, আমি র্যাবের লোক এই মসজিদে অস্ত্র আছে। এরপর সে একটি র্যাক খুঁজে আরেকটি র্যাকের কাছে যায়। ওই র্যাকে একটি কোরান শরীফ ছিল। সেই র্যাকে পা দিয়ে সে তল্লাশী করছিল। এরপর মসজিদের হুজুর (ইমাম) তাকে বের করে দেন। বাইরে লোকজন মারধর শুরু করে। পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলে ১ নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার (কাউন্সিলর) হাফিজুল সেখান থেকে তাকে নিয়ে যায় ইউনিয়ন পরিষদের দিকে।’’
জাবেদ আলী আরো বলেন, ‘‘আমার দেখা মতে ওই ব্যক্তি ধর্মীয় অবমাননার কোনো কথা বা কাজ করেনি। সে পিছনের কাতারে আসরের নামাজও পড়েছে।’’
মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজউদ্দিন বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি আসরের নামাজ পড়ার পর ইমাম সাহেবের সঙ্গেও মোসাহাবা (হাত মেলানো) করেন, কথাও বলেন। সে মসজিদের র্যাকের জিনিসপত্র উল্টাপাল্টা করায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে আমরা মেম্বারের হাতে তাকে তুলে দেই।’’
কাউন্সিলর হাফিজুল ইসলামের দাবি, তিনি সেখান থেকে ওই ব্যক্তিকে বুড়িমারি বাজারে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নিয়ে একটি কক্ষে তালা মেরে আটকে রাখেন। পুলিশকে খবর দেয়া হয়। এর মধ্যে শত শত মানুষ জড়ো হয়। পুলিশ আসে, ইউএনও আসেন, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আরো অনেকে আসেন। তারা সবাইকে শান্ত হতে বলেন। আইন অনুয়ায়ী শাস্তি দেয়ার কথা বলেন। কিন্ত এক পর্যায়ে উন্মত্ত লোকজন ওই ব্যক্তিকে তালা ভেঙে ছিনিয়ে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ আরেকটি জায়গায় নিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
কাউন্সিলর আরো বলেন, ‘‘পুলিশ প্রশাসনের সামনেই ঘটনা ঘটে। আমরাও আহত হয়েছি। আমরা একটি মাইক লাগিয়ে সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই ঘটনা ঘটে যায়।’’
পুলিশের ভূমিকা
শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করা হয়নি। কাউন্সিলর বলেন, ‘‘আমরা জানিনা কারা হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের চিনি না। তবে ভিডিও ফুটেজ আছে। পুলিশ তা দেখে চিহ্নিত করতে পারবে।’’
তবে সার্কেল এএসপি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি পুলিশ ও প্রশাসনের সামনে এই হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটলো, কারা এজন্য দায়ী।’’
ধর্মীয় অবমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত পর্যায়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।’’
এই ঘটনা তদন্তের জন্য লালমরিহাট অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ইউনূসের লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছু হাড় অবশিষ্ট আছে। সেগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার পর ওই দেহাবশেষ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
হত্যাকাণ্ডের শিকার ইউনূসের ভাই আক্কাস জানান,দেহাবশেষ পেলে তারা দাফনের ব্যবস্থা করবেন। তিনি আরো জানান, ‘‘মামলার জন্য পুলিশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।’’
হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে নিহতের ভাই আরো বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে আর কাউকে যেন হত্যা না করা হয় তার ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।’’
গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স করা আবু ইউনূস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী ওরফে জুয়েল ১৯৯৫ সাল থেকে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার পর থেকে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয় বলে তার ভাইয়ের দাবি। স্ত্রী এবং দুই সন্তান রেখে গেছেন ইউনূস৷
ফায়দা লোটার জন্য উন্মাদনা?
বাংলাদেশে যে-কোনো অভিযোগ তুলে মেরে ফেলার ঘটনা এই প্রথম নয়। গত বছর পদ্মা সেতুতে ‘শিশুর মাথা লাগবে' গুজন ছড়ানো হয়। তারপর ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি ঢাকায় তাসলিমা কেগম রেনু নামে এক নারীকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।চলতি বছরের সেপ্টম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রর(আসক)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গুজব ছড়িয়ে বা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে এই ধরনের হত্যার ঘটনা অনেক আগে থেকেই ঘটছে। মধ্যযুগের সেই নৃশংসতাএখনো আছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও ধর্মের নামে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। অন্ধ চিন্তাই এর প্রধান কারন।’’ তিনি মনে করেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এটা কমাতে পারে। এমন অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি৷
ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে একটি গোষ্ঠী তাদের ফায়দা লুটতে চায়, তারাই লালমনির হাটের ঘটনার সাথে জড়িত বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও গুজব ছড়াতে ব্যবহার করছে। তাই এখনই সতর্ক না হলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে।’’