1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঐতিহ্য থাকুক, আপত্তি বাণিজ্যে

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
৭ জুন ২০১৯

শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা বন্ধ হয়ে যাবে?‌ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে হতাশ, ক্ষুব্ধ, বিচলিত অনেকেই। কিন্তু সম্ভবত পৌষমেলার ঐতিহ্যকে বাঁচাতেই এই মেলা বন্ধের হুমকি।

https://p.dw.com/p/3K0jY
Indien Kalkutta Home of Rabindranath Tagore
ছবি: DW/P. Samanta

শান্তিনিকেতনে প্রথামাফিক ৭ পৌষের উৎসব হবে, প্রতিষ্ঠা দিবসের আনুষঙ্গিক যা যা অনুষ্ঠান, সব হবে। কিন্তু পৌষমেলা করার দায়িত্ব আর নিজের হাতে রাখতে চায় না বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। শিরোনামহীন, ঠিকানাবিহীন, অস্বাক্ষরিত এবং শিলমোহর ছাড়া সাদা কাগজের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই চরম সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বিশ্বভারতী। ডয়চে ভেলে–কে এই নাম–গোত্রহীন বিজ্ঞপ্তির খবর দিলেন পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত, যিনি গত চার বছর ধরে পরিবেশ আদালতে পৌষমেলার কারণে হওয়া নানা দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনিই বোঝালেন, কেন এমন স্বাক্ষরবিহীন ঘোষণাপত্র। কারণ পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা কার্যত আদালত অবমাননা, যা জরিমানাযোগ্য অপরাধ। কাজেই কেউ সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। অন্যদিকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, পরিবেশ আদালত দূষণ নিয়ন্ত্রণের যে সমস্ত বিধি বেঁধে দিয়েছে, তা মেনে পৌষমেলা করার মতো পরিকাঠামো বিশ্বভারতীর নেই। এমনকি এ সংক্রান্ত মামলা চালিয়ে যাওয়ার মতো লোকবল, অর্থবল না থাকার কারণেও হাত গুটিয়ে নিতে চায় বিশ্বভারতী।

তা হলে সেই ১৮৯৪ সাল থেকে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলা কি বন্ধ হয়ে যাবে?‌ তা সম্ভবত হবে না, কারণ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি দুদিন পরেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যকে টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন, এ বছর থেকে মেলার দায়িত্ব নেবে সরকার। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সম্ভবত এটাই চাইছিলেন, যে মেলাটা থাক কিন্তু তার দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, বা সেই সংক্রান্ত আইনি জটিলতা যেন তাদের ভোগ করতে না হয়। কিন্তু সুভাষ দত্তের বক্তব্য, দূষণের মোকাবিলা করতে পারছি না, তাই মেলা করব না, এটা কোনও কথা হতে পারে না। ডয়চে ভেলে–কে তিনি স্পষ্ট জানালেন, ‘‌মেলা সম্পর্কে আমাদের তো কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু মেলাটা যেভাবে করা উচিত, সেভাবেই করতে হবে। .‌.‌.‌ আমরা পরিবেশবিধি মেনে করতে পারব না, সেই জন্য মেলাটাই বন্ধ করে দিলাম, তা হলে তো রবি ঠাকুরের ধারণার প্রতি অবমাননা করা হয়।

স্বপন ঘোষ

রবি ঠাকুর যদি জানতেন, যে এইভাবে মেলা হয়, শয়ে শয়ে লোক এইভাবে আগুন পোহাবে, কাঠ জ্বালিয়ে, খড় পুড়িয়ে;‌ ওখানে অতগুলো উনুন তৈরি হবে;‌ অতগুলো শৌচাগার তৈরি হবে;‌ জলের ব্যবস্থা থাকবে না, এবং প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য সেখানে জমা হয়ে থাকবে, পরিষ্কার করা হবে না, এবং সলিড ও লিকুইড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট একদম থাকবে না বিশ্বভারতীতে (‌তা হলে হয়ত তিনিও অনুমতি দিতেন না!‌'‌ সুভাষ দত্ত এ কথাও বললেন, যে বিশ্বভারতীর উপাচার্য, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ‘‌স্বচ্ছ ভারত অভিযান'‌–এর ধারণারও পরিপন্থী এই মেলা।
তবে পৌষমেলা না হওয়ার সম্ভাবনায় যতটা বিচলিত বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীরা, যাঁরা এই মেলাকে কার্যত তাঁদের পুনর্মিলন উৎসব করে তোলেন প্রতি বছর, ততটাই নির্বিকার বর্তমান আশ্রমিকরা, যাঁরা বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বা আছেন এবং এখনও শান্তিনিকেতনেই থাকেন। বিশ্বভারতী পাঠাগারের প্রাক্তন প্রধান গ্রন্থাগারিক এবং বোলপুরের বাসিন্দা স্বপনকুমার ঘোষ যেমন জোর দিয়ে বললেন, ‘৭ পৌষের প্রতিবারই তার নিজের নিয়মে আবির্ভাব হবে। গৌরবময় আবির্ভাব ঘটবে, এর কোনও ব্যত্যয় হবে না। পৌষ উৎসব এবং মেলা, দুটোর সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ।‌ তিনি এই দুটো মেলার সূচনা করেছিলেন। এবং এই মেলাটা ধীরে ধীরে একটা বাণিজ্যিক মেলার রূপ নিয়েছে। বিশ্বভারতী যে কথাটা বলছে, সেটা খুবই প্রাসঙ্গিক। তাদের পক্ষে চালানো মুশকিল। শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের পক্ষেও একা করা মুশকিল।'‌
বস্তুত আজকের পৌষমেলার মূল সমস্যা লুকিয়ে আছে ওই একটি শব্দেই। বাণিজ্য। স্বপনবাবু কথাটা সরাসরি না বললেও অনেক আশ্রমিকই প্রকাশ্যে অথবা একান্তে বলছেন, রবীন্দ্রনাথের সাদাসিধে পৌষমেলার ধারণাকে গ্রাস করেছে বৃহৎ বাণিজ্যিক গোষ্ঠী এবং ব্যবসায়ী সমিতির জোট। যে গ্রামীণ শিল্পকে তুলে ধরতে এই মেলার সূচনা, তা এখন সরে গেছে দূরে। সেই জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক জোট। তিনদিনের মেলা টেনে বাড়ানো হয়েছে সাত দিনে। এবং সেটাও হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক বাণিজ্যিক এক মোচ্ছব, যার ব্যবসা এবং মুনাফা ছাড়া আর কোনও দায়দায়িত্ব নেই। এই বিপুল আয়োজনকে জায়গা দেওয়ার সামর্থ বা পরিকাঠামো যেমন সত্যিই বিশ্বভারতীর নেই, তেমনি ক্ষমতাও নেই অর্থ এবং রাজনীতির এই দাপটকে নিয়ন্ত্রণ করার। কাজেই মেলার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দিতে পারলে তারা নিশ্চিন্ত হন।
দূষণ ছাড়াও পৌষমেলা বোলপুর–শান্তিনিকেতনের জনজীবনকে ওই সাত দিনের জন্য বিপর্যস্ত করে দেয়। ডয়চে ভেলে–কে জানালেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী এবং শান্তিনিকেতনেরই বাসিন্দা বিদিশা ঘোষ। যে রিকশভাড়া বেড়ে যাওয়া, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাঁদের রাস্তায় বেরোনো অসম্ভব হয়ে যায়। অনেকেই মেলার কদিন শান্তিনিকেতন ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। যাঁরা থেকে যান, তাঁরা খুব সন্ত্রস্ত থাকেন যে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তা হলে কি মেলা না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা সরকারের উদ্দেশে এক আবেদন, যে এই অব্যবস্থা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব এবার সরকার নিক?‌ বিদিশা জানাচ্ছেন, এটা একটা নতুন দিক, যেটা নিয়ে ওঁরা এখনও ভাবেননি। ‘‌তবে পরিবেশ দূষণ যে হারে বেড়েছে, এবং ব্যবসায়ীদের চক্র যতটা বেড়েছে, তাতে উল্টো দিক থেকে এটা দেখার জন্যও হতে পারে, যে বন্ধ করলাম, এবার কী করবে করো!'‌ বললেন বিদিশা।
তবে পৌষমেলা সত্যি বন্ধ হয়ে গেলে বহু দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়বেন বলে শঙ্কিত বিদিশা। যে বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো এসে গেড়ে বসেছে, পৌষমেলা তাদের নয়। বরং নেহাতই সামান্য, ছোট ব্যবসায়ীদের ছোট পশরার জন্যই মূলত ছিল এই মেলা। এছাড়া মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যে মঞ্চ, সেখানে বাউল গান ছাড়াও দিনভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সেটাও পৌষমেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন ওঁরা। ফলে ওঁদের ইচ্ছে, বাণিজ্যের দাপট কমুক, পৌষমেলা ফিরে আসুক তার নিজস্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত চেহারায়। এবং মেলা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলে বিশ্বভারতী সম্ভবত গোটা বিষয়টিকে সেইদিকেই ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে। যেন সরকারকে মাঝখানে রেখে বাণিজ্যের দাপট কমে। অর্থবানদের দাপট কমুক। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ সমস্যারও সুরাহা হোক। আর ফিরে আসুক পুরনো পৌষমেলা।
পৌষমেলা বিতর্কের গোটা বিষয়টা খুব সম্ভবত সেই দিকেই এগোচ্ছে। যে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বপনকুমার ঘোষ, যে ‘কোনওরকমের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটা সর্বস্তরে আলোচনা করা উচিত। ছাত্র, ছাত্রী, আশ্রমিক, শিক্ষক এবং যাঁরা রবীন্দ্রবান্ধব আছেন, এবং জেলা প্রশাসন তো অবশ্যই। যে সমাধানের রাস্তা কী হতে পারে।'‌ ‌ ‌ ‌

বিদিশা ঘোষ

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য