কতটা স্বায়ত্তশাসিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন?
৪ জানুয়ারি ২০২৩২০২২ সালের নভেম্বরে মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলের পর বার্লিন এবং ব্রাসেলসের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল৷ তবে রিপাবলিকানরা মার্কিন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর যতটা নাটকীয় হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তেমনটা হয়নি৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন হারানোর আভাসও পাওয়া গেছে এই নির্বাচনে৷
তবে বার্লিনের গ্লোবাল পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউট এর পরিচালক থর্স্টেন বেনার মনে করেন, এখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময় আসেনি৷ নির্বাচনের পরপরই ডয়চে ভেলের জন্য লেখা একটি উপ-সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেন, ‘‘হোয়াইট হাউজে আসা শেষ ট্রান্স-আটলান্টিসিস্ট (ইউরোপ-অ্যামেরিকা সহযোগিতা) প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইতিহাসে লেখা থাকবে বাইডেনের নাম৷''
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে হোয়াইট হাউসে যেই আসুক না কেন উদার নিরাপত্তা নীতি সমর্থনের সময় শেষ হয়ে আসছে৷ ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে চীনের দিকে আরও বেশি মনোনিবেশ করবে।
বার্লিনের এজেন্ডায় ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন'
অ্যামেরিকা ধীরে ধীরে ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ বিশ্বশক্তি হিসাবে চীন আত্মপ্রকাশ করছে, পুটিনের রাশিয়া একটি স্বাধীন ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করেছে৷ ইউরোপীয়রা এখন বাস করছেন নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে৷
ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য কেই প্রস্তুত না থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের অবস্থান ইউরোপীয়দের জন্য় নতুন নয়। ফলশ্রুতিতে "কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন" শব্দটি ইউরোপের রাজনৈতিক পরিভাষায় প্রবেশ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তিক ওপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় ইইউ।
২০২১ সালে জার্মানির তিন-দলীয় জোট সরকারের চুক্তিতে বলা হয়েছে: "আমরা ইউরোপের কৌশলগত সার্বভৌমত্ব বাড়াতে চাই। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং নিরাপত্তাহীনতার এই বিশ্বে আমরা একটি সার্বভৌম ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে চাই৷"
জার্মানির ‘আত্মতৃপ্তির' সমালোচনা
কিন্তু ইইউ এবং জার্মানি এই লক্ষ্যে কতটা এগিয়েছে? ইউরোপের সার্বভৌমত্ব সূচক প্রকাশ করে ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস- ইসিএফআর৷ এ সূচকে জলবায়ু সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, অভিবাসন এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলি বিবেচনায় নেয়া হয়।
এই সূচক অনুসারে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন উচ্চ মাত্রার সার্বভৌমত্ব ভোগ করে৷ প্রতিরক্ষা, জলবায়ু সুরক্ষা এবং অভিবাসনে ইউরোপ রয়েছে সন্তোষজনক স্তরে৷ কিন্তু প্রযুক্তিখাতে ইইউকে বিশেষভাবে অন্যদেশের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়।
ইইউ এর কোন সদস্য রাষ্ট্র ইউরোপের সার্বভৌমত্বে কেমন ভূমিকা রাখছে, এ নিয়ে ২০২২ সালের জুনেএকটি সূচক প্রকাশ করা হয়৷ জার্মানি স্থান পেয়েছে তালিকার শীর্ষে৷ এর কারণ কেবল জার্মানি শক্তিশালী হওয়া নয়৷ ইসিএফআর এর মতে, "ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাজ করার ক্ষমতা" বাড়াতে জার্মানি অনেক বিনিয়োগ করে এবং ইউরোপের সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রকাশ্য়ে অঙ্গীকারও করে৷
একটি ইস্যুতে অবশ্য জার্মানির ভূমিকা নেতিবাচক হিসাবে নিহ্নিত হয়েছে৷ পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও, ইউরোপের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে অবদানের সূচকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে জার্মানি৷ এই বিষয়টি রাশিয়া এবং চীনের ওপর জার্মানির নির্ভরশীলতার পরিচয় দেয়৷ গবেষকেরা এই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন জার্মানিকে৷
ইউরোপে সবার স্বপ্ন এক নয়
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য অর্জন থেকে ইউরোপ এখও অনেক দূরে অবস্থান করছে বলে মনে করেন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এর হেনিং হফ৷ তিনি বলেন, "ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ দেখিয়েছে যে ইউরোপীয়রা প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।"
এটি প্রচলিত যুদ্ধের পাশাপাশি পারমাণবিক হুমকির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। শুধু ইউরোপের ওপর নির্ভর করে থাকতে হলে এখন ইউক্রেনের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না বলে মনে করেন হফ৷
এখন কেবল মূলত ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁই ইউরোপের সামরিক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন। ব্রেক্সিটের পর থেকে ফ্রান্সই একমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ যাদের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
সামরিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ইউরোপীয়রা বিভক্ত। বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এবং পোল্যান্ডের মতে, ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর শক্তিশালী ভূমিকা বজায় রাখা উচিত।
তবে, ব্রাসেলস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইউরোপীয় পলিসি সেন্টারের মিহাই চিহাইয়া বিশ্বাস করেন যে নানা ধরনের স্বার্থকেও এক করে দেখার সুযোগ রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র ইইউ-এর স্বনির্ভরতার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। চিহাইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আরও সক্ষম ইউরোপীয় ইউনিয়ন ট্রান্স-আটলান্টিক নিরাপত্তায় অবদান রাখবে এবং ন্যাটোর পরিপূরক হবে৷"
ফরাসি-জার্মান বন্ধুত্ব
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই বৃহত্তম দেশ জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে সুসম্পর্কই এই জোটের মূল শক্তি হিসাবে দেখা হত। কিন্তু এখন সেই সম্পর্কে কিছুটা তিক্ততা দেখা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ যৌথ এফসিএএস যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা প্রকল্প আটকে রয়েছে৷
জার্মানির যেকোনো অভ্যন্তরীণ জাতীয় কার্যকলাপ এবং সিদ্ধান্তেরও যে ইউরোপীয় প্রভাব পড়বে, এই সত্য উপেক্ষা করার জন্য জার্মান সরকারের সমালোচনা করেছেন হেনিং হফ৷ তিনি মনে করেন যেকোনো সিদ্ধান্তই ফ্রান্সের সঙ্গে সমন্বয় করে নেয়া উচিত৷ তার মতে, ‘‘শলৎস এখনও ইউরোপের মঞ্চে নিজের ভূমিকা খুঁজে পাননি৷‘‘ ফরাসি-জার্মান দ্বন্দ্ব দ্রুত সমাধান করা না গেলে এর প্রভাব ইউরোপীয় ইুনিয়নেও পড়বে বলে মনে করেন তিনি৷
ক্রিস্টোফ হাসেলবাখ/এডিকে