করোনার কিট নিয়ে ভারত-চীন লড়াই
২৮ এপ্রিল ২০২০ভারতের অভিযোগ, চীন যে কিট রপ্তানি করেছিল, তা ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু চীনের বক্তব্য, ভারত কিট ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেনি। চীনকে যে ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।
ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহ দুয়েক আগে। ভারতে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চীনের দু'টি কোম্পানি থেকে প্রচুর পরিমাণে কিট আমদানি করে ভারত। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তা বন্টন করা হয়। ওই কিটগুলির সাহায্যে খুব কম সময়ে রক্তের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যায় কারও শরীরে করোনা ভাইরাস আছে বা ছিল কি না। কিন্তু কিট পৌঁছনোর কয়েক দিনের মধ্যেই রাজ্যগুলি বলতে শুরু করে, কিট ত্রুটিপূর্ণ। ওই কিটের সাহায্যে করোনা পজিটিভ রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেও দেখা যাচ্ছে রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের রীতিমতো সংঘাতও হয়। কারণ প্রাথমিক ভাবে রাজ্যগুলির অভিযোগ মানতে চাইছিল না কেন্দ্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চও জানায় ওই কিটে সমস্যা আছে। এর পরেই চীনের কাছ থেকে আর কিট নেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় নরেন্দ্র মোদী সরকার। দেশে পরীক্ষা আরও বাড়ানোর জন্য কয়েক লাখ নতুন কিটের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল চীনকে। সেই অর্ডারও রাতারাতি বাতিল করে ভারত।
এতেই ক্ষুব্ধ হয় চীন। দিল্লিতে অবস্থিত চীনের দূতাবাস বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে চীন অত্যন্ত সচেতন। ত্রুটিপূর্ণ জিনিস রপ্তানি করার প্রশ্নই ওঠে না। যে দু'টি সংস্থার থেকে ভারত কিট আমদানি করেছিল তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, তাতে কোনও সমস্যা ছিল না। ফলে ভারতের এ হেন অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। শুধু তাই নয়, চীনের বক্তব্য, শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই সংকট কালে তারা কিট রপ্তানি করেছে। কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি। ভারত এ কথা বলছে কারণ, ভারতে কিট ঠিক মতো ব্যবহার হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত আছে। এক দলের বক্তব্য, চীনের কাছ থেকে যে কিট ভারত নিয়েছিল, তাতে জটিলতা ছিল। অনেক গুলি ভেরিয়েবল বা বিষয় মিলিয়ে পরীক্ষা করলে তবেই নির্ভুল ফলাফল পাওয়ার কথা ছিল। প্রক্রিয়ায় সমস্যা হওয়াতেই ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট মিলেছে। এটা কিটের দোষ বলা যায় না। প্রক্রিয়ার দোষ বলতে হবে। যুক্তির পক্ষে তাঁদের বক্তব্য, আইসিএমআর পরীক্ষা করেই ওই কিট কিনেছিল। ত্রুটি থাকলে তখনই তা ধরা পড়তো।
অন্য পক্ষের যুক্তি, কিটে সমস্যা ছিল। একই পরীক্ষায় দু'রকম ফলাফলও মিলেছে। তাঁদের আরও বক্তব্য, দিল্লি আইআইটির গবেষকরা যে কিট বার করেছেন, তার সাহায্যে অনেক সহজে পরীক্ষা করা সম্ভব। ফলে চীনের কিটের বদলে আইআইটির কিট ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত।
বস্তুত, ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক আধিকারিকও সেই একই কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, চীনের কিট ত্রুটিপূর্ণ এবং খরচ সাপেক্ষ। এখন যখন দেশেই কিট তৈরি হয়ে গিয়েছে, তখন চীন থেকে আমদানি করার আর মানে হয় না। শুধু তাই নয়, দিল্লি হাইকোর্টও জানিয়েছে, করোনা পরীক্ষার জন্য এক হাজার টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। দেশীয় কিটের সাহায্যে তা রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু চীন থেকে কিট আনালে খরচ বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। সেই সব দিক বিবেচনা করেই ভারত অর্ডার বাতিল করেছে বলে কূটনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য।
ভারত এবং চীনের সম্পর্ক বরাবরই নরমে গরমে। ভারতের বিশাল বাজারের কথা মাথায় রেখে চীন ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কই রাখতে চায়। কিন্তু লাদাখ এবং অরুণাচলে সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক মাঝেমাঝেই সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। একই সঙ্গে তিব্বত থেকে পালিয়ে এসে দলাই লামার ভারতে বসবাস কখনওই ভালো চোখে দেখে না চীন। অন্য দিকে, চীন যে ভাবে ভারতের বাজার গ্রাস করেছে, তা নিয়ে ভারত সরকারও খুশি নয়। গত কয়েক বছরে চীনের সেনা সীমান্তে যে ভাবে 'আগ্রাসী' মনোভাব দেখিয়েছে, তাও ভারত খুব ভালো চোখে দেখেনি। ফলে কূটনৈতিক ভাবে দু'দেশের মধ্যে সব সময়ই একটা টানাপড়েন চলে। করোনার কিট নিয়ে নতুন এই বিতর্ক সেই টানাপড়েনে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এসজি/জিএইচ (রয়টার্স, পিটিআই)