করোনার লক্ষণ ছাড়া রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ
২৭ এপ্রিল ২০২০কিছু দিন আগেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) জানিয়েছিল, ভারতে যাঁদের করোনা ধরা পড়ছে, তাঁদের ৮০ শতাংশের শরীরেই কোনও রকম সিম্পটম বা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন বলেই তাঁদের পরীক্ষা করা হয়েছিল। আর তাতেই দেখা গিয়েছে, কোনও রকম লক্ষণ ছাড়াই তাঁদের শরীরে বাসা বেঁধেছে কোভিড-১৯। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন আইসিএমআর-এর চিকিৎসকরা। বিষয়টি যে উদ্বেগজনক, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রকও তা স্বীকার করে নিয়েছে। তা হলে উপায় কী?
ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ কেবল ভারতের সমস্যা নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই এই সমস্যা রয়েছে। কারণ, এখানে কম বয়সীদের সংখ্যা বেশি। তাঁদের শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ ঘটলেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ার জন্য করোনা তাদের আক্রান্ত করতে পারছে না। কিন্তু ভাইরাস দেহে বাসা বেঁধে থাকছে। লক্ষণহীন ওই ব্যক্তি যখন সমাজের অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, তখন তাঁদের শরীরেও করোনার সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে। এর মধ্যে যাঁরা দুর্বল অথবা বয়স্ক, তাঁরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফলে এ দেশে করোনার গোষ্টী সংক্রমণ হয়নি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
কলকাতার ট্রপিকাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধ্যাপক ও আধিকারিক এবং ভাইরাস সংক্রান্ত রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অমিতাভ নন্দী এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে। ভারতে কালাজ্বর এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। অমিতাভবাবু জানিয়েছেন, ''আইসিএমআর যে কথা বলেছে, তা সমুদ্রের উপর জেগে থাকা হিমশৈলের মতো। জলের তলায় কতটা পাহাড় আছে, আমরা জানতেও পারছি না। কারণ, ভারতে করোনার টেস্ট কমিউনিটির মধ্যে গিয়ে হচ্ছে না। কেবলমাত্র যাঁদের শরীরে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাঁদেরই টেস্ট হচ্ছে। পরীক্ষা হচ্ছে আক্রান্তরা যাঁদের সঙ্গে মিশেছেন তাঁদেরও। ফলে আইসিএমআর যে তথ্য দিয়েছে, তা সমাজের খুবই সামান্য একটি অংশের।'' অমিতাভবাবুর বক্তব্য, ''দেশের করোনা পরিস্থিতি যদি সত্যি সত্যিই বুঝতে হয় এবং ব্যবস্থা নিতে হয়, তা হলে কমিউনিটি বা গোষ্ঠীর ভিতরে গিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে টেস্ট করতে হবে। একটি ডেটাবেস তৈরি করতে হবে। তাহলেই ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়া এবং ভৌগোলিক অবস্থানে করোনার আচরণ স্পষ্ট হবে। চিকিৎসা পদ্ধতিও সে ভাবে চালু করা যাবে।'' অমিতাভবাবু জানিয়েছেন, ''করোনা নিয়ে ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না। কী ভাবে এর মোকাবিলা করা যায় সেই রাস্তাগুলো খুঁজতে হবে। এবং তার জন্য অনেক বেশি পরীক্ষা দরকার।''
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এতিদন যুক্তি ছিল, সকলকে পরীক্ষা করার মতো টেস্ট কিট এ দেশে নেই। বিদেশ থেকে তা আমদানি করতে হচ্ছে। খরচও অনেক। ফলে কমিউনিটি টেস্ট এখনই সম্ভব নয়। বস্তুত, চীন থেকে ভারত যে টেস্ট কিট এনেছিল তাতেও অনেক গোলমাল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আইআইটি দিল্লির গবেষকরা সস্তার টেস্ট কিট বানিয়ে ফেলেছেন। দিল্লির দুই বাঙালি বিজ্ঞানীও সস্তার টেস্ট কিট তৈরি করে আইসিএমআর-কে পাঠিয়েছেন। সেই কিটও কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে চলে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিট নেই, এ কথা এখন আর বলা যাবে না। ফলে দ্রুত দেশ জুড়ে টেস্টের সংখ্যা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে হবে সরকারকে। তাহলেই বাস্তব পরিস্থিতি স্পষ্ট হবে।
চিকিৎসক সাত্যকি হালদারও বহুদিন ধরে এ কথা বলে আসছিলেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, লকডাউন করে দিনের পর দিন কাটানো যাবে না। মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতেই হবে। ফলে দ্রুত বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া দরকার। দেখা দরকার যাঁদের শরীরে সংক্রমণ ঘটেছে কিন্তু লক্ষণ নেই, তাঁদের শারীরিক অবস্থা ঠিক কেমন। কী ভাবে তাঁদের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে। লক্ষণহীন আর লক্ষণযুক্তের আনুপাতিক হার কী? এই বিষয়গুলি বুঝতে পারলে এর চিকিৎসা করাও অনেক সহজ হবে। এলাকাভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা যাবে। সাত্যকিবাবুর কথায়, ''যে কোনও রোগের সামাজিক অবস্থানটা চিহ্নিত করে ফেলা খুব জরুরি। সেটা করতে পারলে চিকিৎসা ব্যবস্থাও সে ভাবে সাজিয়ে নেওয়া যায়।''
অমিতাভবাবু আরও একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ''বিষয়টি অনেকটা সীমান্তে দুই দেশের অনাক্রমণ চুক্তির মতো। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যাঁদের বেশি তাঁদের শরীরে প্রবেশের পরে ভাইরাসের সঙ্গে শরীরের একটি অলিখিত চুক্তি হচ্ছে। কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। ফলে রোগের লক্ষণও প্রকাশ পাচ্ছে না। আর তাদের মধ্য দিয়েই গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা।'' এর আগে কালাজ্বর এবং ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কমিউনিটি টেস্ট সাহায্য করেছে বলে অমিতাভবাবুর দাবি। তাঁর ধারণা, করোনার ক্ষেত্রেও কমিউনিটি টেস্ট শুরু হলে চিকিৎসকদের পক্ষে কাজ করা অনেক সুবিধাজনক হবে। কারণ, দ্রুত রোগীকে চিহ্নিত করতে পারলে তাকেও যেমন সুস্থ করা সম্ভব, সংক্রমণও রোধ করা সম্ভব।