করোনা ও অর্থনীতি: কিভাবে সামলাবে সরকার?
১৭ মে ২০২০বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি৷ সেটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনো নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না৷ অন্যদিকে সারা বিশ্বের মত চাপের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতিও৷ এমন অবস্থায় কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে, মানুষের জীবন না অর্থনীতি? এ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন একজন অর্থনীতিবিদ এবং একজন চিকিৎসক?
অর্থনীতিতে প্রভাব
বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে যেতে পারে৷ যেখানে অর্থবছরের শুরুতে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার৷
এরিমধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে গেছে৷ কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহণ শ্রমিক, রিকশা চালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের কোন কাজ নেই৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল এই এক মাসে অর্থনীতিতে এক লাখ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ আর কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা৷
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এই করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন আর অনুমান করা সম্ভব হচ্ছেনা৷ কারণ করোনার শেষ সম্পর্কে আমরা এখনো ধারণা করতে পারছিনা৷ ক্ষতির পরিমান, জিডিপির ক্ষতি এখন যা বলা হচ্ছে তা প্রজেকশনের ভিত্তিতে৷ বাস্তবতা হতে পারে আরো ভয়াবহ৷’’
যেভাবে অর্থনীতি সচল করা হচ্ছে
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করতে এরইমধ্যে পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে৷ ঈদকে সামনে রেখে সীমিত আকারে দোকানপাট ও শপিং মলও চালু হয়েছে৷ তবে জরুরি পরিবহণ ছাড়া আর সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে ২৬ মার্চ থেকে৷
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন বিএমএ'র মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, বলেন, ‘‘সরকার তার বিবেচনায় অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়ে সব কিছু ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে৷ কিন্তু আমার বিবেচনায় সঠিক পদ্ধতিতে হয়নি৷
তিনি বলেন, ‘‘পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার আগে সব শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি ছিলো৷ কিন্ত তা না করে সবাইকে কাজে নেয়া হয়ছে৷ ঈদের আগে কিছু নির্দেশনা দিয়ে দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ এটা ঠিক হয়নি৷ আমাদের করোনা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এখনো জানি না৷ সেটা না জেনে এভাবে সব কিছু খুলে দেয়া ঠিক না৷ আর যেটা খুলতে হবে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানতে হবে৷''
তবে তিনি সাধারণ মানুষের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দাবী জানিয়ে অভিভাবকরা স্কুল কলেজ বন্ধ করে কক্সবাজারে ঘুরতে গেলেন৷ এটা কিভাবে হয়! আবার এখন দোকানপাটে ঈদের কেনাকাটার জন্য ভিড় করছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না৷ নিজের জীবনের সিদ্ধান্ততো নিজেকেই নিতে হবে৷ ঘরে বেধে রাখা তো সরকারের দায়িত্ব না৷ সরকার তো প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছে৷’’
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা কতটা
রোববার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক হাজার ২৭৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন৷ মোট করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৬৮ জন৷ মোট প্রাণ হারিয়েছেন ৩২৮ জন৷ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে৷ পাশাপাশি বড় ধরনের চাপ সামলাতে হবে স্বাস্থ্যখাতকে৷
এরইমধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা চরমভাবে ফুটে উঠেছে৷ এখন ৪১টি সেন্টারে করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ ঢাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল রয়েছে আটটি৷ জেলা হাসপাতালগুলোতে আলাদা করোনা ইউনিট করা হয়েছে৷ উপজেলা পর্যায়ে করা হয়েছে আইসোলেশন সেন্টার৷ কিন্তু তারপরও পরীক্ষার এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা আছে৷ অন্যদিকে সাধারণ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেকটা ভেঙে পড়েছে৷
এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা দরকার৷ এটা এখন প্রমাণিত যে এই দুই খাতে বরাদ্দই হলো সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ৷ ভিয়েতনামের মত দেশ তা প্রমাণ করেছে৷ আমরা দুর্বল বলেই করোনা নিয়ে কোনো গবেষণা করে ভবিষ্যত নির্দেশনা দিতে পরছি না৷ করোনা হাসপাতালগুলোতে মাত্র ২০০ আইসিইউ বেড আছে৷ তাহলে কিভাবে আমরা যুদ্ধ করবো?’’
চলতি বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা৷ যা জাতীয় বাজেটের চার দশমিক ৯২ শতাংশ৷ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জনপ্রতি বরাদ্দের পরিমান বছরে মাত্র ১৪২৭ দশমিক ৭৭ টাকা৷ সেখানে আছে দুর্নীতির অভিযোগও৷ এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘এই খাতে দুর্নীতি ঢাকতে এখন অনেক অসত্য তথ্য দেয়া হচ্ছে৷’’
কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত?
ইউরোপ সহ বেশ কিছু দেশে লকডাউন পরিস্থিতি তুলে নেয়া হচ্ছে৷ ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে সচল করার পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা৷ বাংলাদেশে কি তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘সুস্থ মানুষই অর্থনীতি সচল রাখে৷ তাই মানুষই যদি টিকে না থাকে তাহলে অর্থনীতি সচল থাকবে কিভাবে৷ এটা শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দুনিয়ারই পরিস্থিতি৷ আমাদের এখানে সরকারি চাকরিজীবী আর বড় কর্পোরেট খাতের লোকজন এখনো বেতন পাচ্ছে৷ কিন্ত কতদিন পাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷’’
এই পরিস্থিতিতে সতর্ক ও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন৷ তার মতে, ‘‘বাংলাদেশের সামনে এখনো সময় আছে, সুযোগ আছে৷ কারণ আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিমান তুলনামূলকভাবে এখনো কম৷ কিন্তু সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে৷ যদি এটা বেড়ে যায় তাহলে চিন্তা করুন খাগড়াছড়ির মত জায়গার কতজনকে আমরা ঢাকায় এনে চিকিৎসা দিতে পারব৷ আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?’’
এহতেশামুল হক চৌধুরীর মতে, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন অঞ্চলকে ভাগ করা যেতে পারে৷ সেখানে ‘রেড জোন', ‘ইয়োলো জোন’, ‘গ্রিন জোন’ থাকবে, যা ভারতেও করা হয়েছে৷ এক এক জায়গার পরিস্থিতি অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা যেতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হলে অর্থনীতিও বাঁচে না এটা আমাদের মনে রাখতে হবে৷ তাই দু’টোর মধ্যে একটি সমন্বয় করতে হয়৷’’
এই বিষয়ে ড. নাজনীন আহমেদের পরামর্শ, ‘‘সিদ্ধান্ত নিতে হবে হট স্পট চিহ্নিত করে৷ সেখানে আমাদের কড়াকড়ি আরোপ করতেই হবে৷ আর যেখানে সংক্রমণ কম বা পরিস্থিতি ভালোর দিকে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে হবে৷ ঢালাওভাবে সবকিছু খুলে দেয়া যাবে না৷ একটা ১০ ফুট বাই আট ফুট দোকানে তো সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব নয়৷ আমাদের ঈদের জন্য দোকান খোলার দরকার নাই৷ আর যেসব দোকান খোলা রাখা দরকার সেসব দোকানে হোম ডেলিভারি চালু করতে হবে৷’’
তিনি মনে করেন ,‘‘জীবন না অর্থনীতি সেটা নিয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ মানুষ বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে৷ আবার অর্থনীতি ধসে গেলে মানুষের বড় বিপর্যয়৷ তাই এখানে সরাসরি কোনো উত্তর নেই৷ সর্বাধিক বেনিফিট যেভাবে হয় আমাদের সেই বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ আর সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে মানুষ৷ সিদ্ধান্ত হবে মানুষের জন্য৷ বেঁচে থাকার জন্য৷’’