কলকাতায় এমন আগুন আরো লাগবে!
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮দমকলের ৩৫টি ইঞ্জিন, শ' দুয়েক দমকলকর্মী রবিবার রাতভোর থেকে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছেন, একটা ৬ তলা বাড়িতে ধরা আগুন বাগ মানাতে পারছেন না৷ রবিবার সারাদিন, সারা রাত, সোমবার দুপুর পর্যন্ত জ্বলেছে সেই আগুন৷ তার সব চেয়ে বড় কারণ, ঘিঞ্জি বাজার এলাকা ক্যানিং স্ট্রিটের রাস্তায় দমকলের ইঞ্জিন ঢুকতেই অনেকটা সময় লেগে গেছে৷ বহুতলের আগুন নেভানোর জন্য যে হাইড্রলিক মই থাকে দমকলের, দীর্ঘ সময় তা কাজে লাগানো যায়নি, কারণ, মাথার ওপর নানা ধরনের কেবল লাইনের জট৷ দমকলকে কার্যত সেই তারের জঙ্গল কাটতে কাটতে পথ করে নিতে হয়েছে৷ যা-ও বা আগুনের উৎসের কাছাকাছি পৌঁছানো গেছে, জলের কোনো জোগান পাওয়া যায়নি৷ পাইপ ফেলে জল আনতে হয়েছে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে গোল দিঘি থেকে৷ সেখানেও যথেষ্ট জল না থাকায় জল তুলতে হয়েছে সেই হুগলি নদী থেকে৷ এতসব জোগাড়যন্তরের পরেও আগুনের সঙ্গে ঠিকভাবে লড়া যায়নি, কারণ, বাগড়ি মার্কেটের ৬টি তলার সবকটি দোকানের লোহার শাটার বন্ধ ছিল৷ একাধিক তালা দিয়ে আটকানো ছিল৷ ফলে বাইরের জানালা থেকে আন্দাজে জল দেওয়া ছাড়া আগুনের উৎসে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি৷ কিন্তু একাধিক দোকানেই সহজ দাহ্য রাসায়নিক, প্লাস্টিক ইত্যাদি মজুত ছিল৷ ফলে দমকলকর্মীরা অসহায়ের মতো দেখেছেন আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে যেতে৷
এই আগুন লাগার ঘটনা আবারও একবার প্রমাণ করল, খাস শহর কলকাতা কতটা অ-সুরক্ষিত, কতটা অনিরাপদ৷ এবং সবথেকে বড় আশঙ্কার কথা, মধ্য কলকাতার এই বিস্তীর্ণ ব্যবসায়িক অঞ্চলে এমন একাধিক বহুতল বাড়ি আছে, যেগুলোতে আগুন লাগলে একই রকম খারাপ, কিংবা আরো খারাপ অবস্থা হতে পারে৷ অধিকাংশই গায়ে গায়ে জোড়া দেওয়া পুরনো আমলের বাড়ি৷ তাদের যা ধারণক্ষমতা, তার থেকে অনেক বেশি লোক তার মধ্যে থেকে ব্যবসা করে৷ কিন্তু সেখানকার ইলেকট্রিক ওয়্যারিং ঠিক নেই, আগুন লাগলে নিরাপদে বেরিয়ে আসার পথ নেই, এমনকি আগুন নেভানোরও ব্যবস্থা নেই৷ বছরের পর বছর ধরে এইরকম অনিরাপদ অবস্থার মধ্যেই জীবিকা অর্জন করছেন বেশ কয়েক হাজার মানুষ৷ প্রত্যেকটা বড় বাজারেই একটা ব্যবসায়ী সমিতি আছে৷ তাদেরই দেখার কথা এই সুরক্ষা ব্যবস্থা৷ দায়িত্ব পুরসভার, দমকল বিভাগের৷ কিন্তু কেউই সে ব্যাপারে সচেতন নন৷ তার ওপরে আছে রাস্তা এবং ফুটপাথের যথেচ্ছ দখলদারি, প্রায় যাতায়াতের রাস্তা আটকে হকারদের রোজকার ব্যবসাপাতি, এবং মাথার ওপর ওই তারের জঙ্গল, যা বাগড়ি মার্কেটে দমকলের রাস্তা আটকে রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ৷ দমকলকর্মীরা আফসোস করেছেন যে, তাঁরা ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারলে এবং জলের জোগান ঠিক থাকলে অনেক ভালোভাবে এই আগুনের মোকাবিলা করা যেতো৷
কিন্তু এরকম বড় বাজার বা বাণিজ্যকেন্দ্রের ক্ষেত্রে কি দমকলের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় না? আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা, তার তদারকির কি কেউ নেই? পুরসভা কি কোনো ফায়ার ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় না? একই এলাকার টেরিটি বাজারে কাগজের পাইকারি ব্যবসা চালান কৃষ্ণেন্দু দে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘সব জায়গাতে নেই৷ কিছু কিছু বড় বড় মার্কেট হয়ত করেছে৷ বা যেসব মার্কেট আগুন লেগে নতুন করে তৈরি করেছে, যেমন নন্দরাম মার্কেট, তারা নতুন করে করেছে৷ কিন্তু ছোটখাটো দু-একটা বাড়িতে কাজ হয়, এমন মার্কেটে এসব নেই৷'' কৃষ্ণেন্দু দে স্বীকার করলেন, ‘‘কর্পোরেশনও এগুলো দেখছে না বা জোর করছে না বা হয়ত বলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুদিন পর তারাও আর যোগাযোগ রাখছে না৷ আবার চাপ দেওয়া, যে কেন হয়নি, বা তার জন্যে কোনো পেনাল্টি করা, সেসব হচ্ছে না৷ নজরদারি দু'তরফেই নেই৷'' ব্যবসায়ীদেরও যে এ ব্যাপারে সচেতন, সতর্ক থাকা উচিত, মনে করেন কৃষ্ণেন্দু দে-র মতো অনেকেই৷ কিন্তু একটা বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে না যাওয়া পর্যন্ত সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না কোনো পক্ষেরই৷ ফলে আশঙ্কা থাকছেই৷ বিশেষ করে মধ্য কলকাতার এই বিশাল বাজার এলাকা কার্যত এক জতুগৃহ হয়ে থাকছে, যে কোনো দিন সেখানে আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে৷