কাতারে মানবাধিকার: ইউরোপের বিন্দু, কাতারের সিন্ধু
৩০ মার্চ ২০২২গত সপ্তাহে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফবি) মূলত দুই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনে বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি জানার উদ্যোগ নিয়েছিল৷ উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য ছিল সার্বিক পরিস্থিতি জার্মানির জাতীয় ফুটবল দলকে জানানো৷ ৯০ মিনিটের এক বৈঠক শেষে আয়োজনের প্রশংসা করে মিডফিল্ডার মাটিয়াস গিন্টার বলেন, ‘‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ৷ সেখানকার (কাতার) বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য এসব বিষয়ে আরো জানা দরকার৷''
কাতারের আয়োজকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, নির্মাণ শ্রমিকদের ভয়ঙ্কর গরমের মধ্যে কম মজুরিতে, বিরামহীনভাবে কাজ করানো এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে কোনো কর্মী অন্য কোথাও কাজ করতে চাইলেও তাকে সেই সুযোগ না দেয়া৷ নিয়োগকর্তাদের অমানবিকতার শিকার হয়ে গত এক দশকে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নির্মাণ শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিননিধিদের কাছে এসব বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা-ই জানতে চেয়েছিলেন জার্মান ফুটবলাররা৷
নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ডিটমার শ্যাফার্স৷ ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিং অ্যান্ড উডওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএইচআই)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘রেড কার্ড ফর ফিফা- নো ওয়ার্ল্ডকাপ উইদাউট হিউম্যান রাইটস' ক্যাম্পেইন শুরু করে ফুটবলের সর্বোর্চ্চ সংস্থাকে তিনি লাল কার্ড দেখানোর বার্তা দিয়েছিলেন ২০১৪ সালে৷পরে বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি এবং কাতারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেনদরবার করে ২০২২ বিশ্বকাপে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রাখারও সুযোগ পান৷ ডয়চে ভেলেকে শ্যাফার্স বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে আমরা ২০১৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবেই কাতার বিশ্বকাপের কন্সট্রাকশন সাইটগুলো দেখে আসছি৷ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত মোট ২৪ বার সাইটগুলো দেখেছি৷''
কাতার ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় ২০১০ সালে৷ তারপর থেকে অনেক নির্মাণ শ্রমিকই স্টেডিয়াম এবং অন্যান্য স্থাপনা তৈরির সময় মারা গেছেন৷ বৈরি, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারানোদের সংখ্যা কয়েক হাজার বলেও কোনো কোনো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ শ্যাফার্স অবশ্য জানালেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের মতো ভয়াবহ নয়, ‘‘কর্মীদের কাজের পরিবেশে একটু পরিবর্তন এসেছে৷ যেমন, এখন প্রচণ্ড গরম থেকে রেহাই দিতে শ্রমিকদের জন্য ‘কুলিং রুম'-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে, কাজের সময় নিয়মিত বিরতিতে বিশ্রামের সুযোগও দেয়া হচ্ছে শ্রমিকদের৷'' এছাড়া আগে যে পাসপোর্ট নিয়োগকর্তার কাছে জমা রেখে শ্রমিকদের একরকম জিম্মি করে রাখার ‘কাফালা আইন' ছিল, তা-ও এখন নেই বলে জানালেন বিএইচআই-এর ভাইস চেয়ারম্যান, ‘‘এখন কাফালা আইনও বিলুপ্ত হয়েছে৷ তাই শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারেন, ইচ্ছে অনুযায়ী নিয়োগকর্তা বদলানোর সুযোগও দেয়া হয় তাদের৷এছাড়া ন্যূনতম মজুরিও ঠিক করে দেয়া হয়েছে৷''
পরিবর্তন: ইউরোপের চোখে এবং কাতারের বাস্তবতায়...
তবে কাজের পরিবেশ আগের চেয়ে ভালো, ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত এবং কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগ হলেও তাতে খুশির কিছু দেখছেন না শ্যাফার্স৷ তার মতে, দুটি কারণে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি একেবারেই কাঙ্খিত পর্যায়ে হচ্ছে না, এক, মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি তদারকিতে লোকের অভাব, দুই, শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুন্ন করা ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি না দেয়া৷ শ্যাফার্স বলেন, ‘‘কাতারে এই মুহূর্তে প্রায় নয় লাখ শ্রমিক কাজ করছেন৷ অথচ পরিদর্শক আছে মোট ২০০ জন৷ প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য৷'' নিজেদের বঞ্চনার কথা এখন একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে আর্বিট্রেশন বোর্ডকে জানানোর সুযোগও দেয়া হচ্ছে শ্রমিকদের৷ তারপরও বঞ্চনা খুব একটা না কমার কারণ জানাতে গিয়ে শ্যাফার্স বলেন, যেসব কোম্পানি অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না, ‘‘ তাদের শুধু জরিমানা করা হয়৷ অথচ আমার মনে হয় তাদের জেলে পাঠানো এবং কোম্পানি বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থাও করা উচিত৷কিন্তু তা কখনো করা হচ্ছে না৷''
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কাটিয়া ম্যুলার-ফালবুশ মনে করেন, ‘‘বিশ্বকাপের কন্সট্রাকশন সাইটগুলোতে যে শ্রমিকরা কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তাদের মাত্র দুই শতাংশের অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে৷বাকি ৯৮ ভাগের জন্য পরিস্থিতি এখনো অনেক খারাপ৷'' তবে তা সত্ত্বেও হতাশায় মুষড়ে পড়ার কারণ দেখছেন না শ্যাফার্স৷ তিনি বলেন, ‘‘সংস্কারে যে সময় লাগবে তা আমাদের মেনে নিতে হবে৷সবকিছু ইউরোপের চোখ দিয়ে দেখলে তো হবে না৷ আধুনিকায়নের জন্য কাতার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে তাদের মানদণ্ডে সেগুলো বিশাল৷ আমাদের অবস্থান থেকে দেখলে সেগুলোকে খুব নগণ্য মনে হতেই পারে৷''
ওলাফ ইয়ানসেন/ এসিবি