কামসূত্রের দেশে যৌন নিগ্রহ
৬ জুন ২০১৪প্রাচীন ভারতের পণ্ডিত মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত এই কামসূত্র হলো এমনই একটি গ্রন্থ, বহু বিদেশি ট্যুরিস্ট ভারতীয় উপমহাদেশের স্মৃতি হিসাবে যেটা কিনে নিয়ে যান৷ তবে একের পর এক বিভৎস ধর্ষণের ঘটনার পর এখন অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে – যে দেশে মানব যৌনাচার নিয়ে এরকম একটি শাস্ত্র লেখা হয়েছে, সেই ভারতে কী করে এ ধরনের যৌন সহিংসতা চলতে পারে!
একজন পুরুষ কীভাবে ধর্ষক হয়ে ওঠে? কেন সে একজন নারীর চেহারা বিকৃত করতে উদ্যত হয়? এ সব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়৷ ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বাদাউন জেলায় সম্প্রতি দুই কিশোরীকে যেভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, তা হতে পারে ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে ধর্ষণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ হতভাগ্য এ দুই কিশোরীই দলিত সম্প্রদায়ের সন্তান, যাঁদের আরেক পরিচয় হলো ‘অস্পৃশ্য'৷ এঁরা এতটাই ‘অচ্ছুত' যে ভারতের বর্ণপ্রথার প্রধান চার স্তরে এঁদের রাখা হয়নি৷
এভাবেই শত শত বছর ধরে দলিত হয়ে আসছে ভারতের দলিতরা৷ আর যাঁদের বিরুদ্ধে ওই দুই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা উচ্চবর্ণের যাদব সম্প্রদায়ের লোক৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও এসেছেন একই সম্প্রদায় থেকে৷
এই ধর্ষকেরা যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের পাশাপাশি খুব সম্ভবত নিজেদের ক্ষমতাও জাহির করতে চেয়েছে৷ মেয়েদুটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেই তাঁরা ক্ষান্ত হয়নি, তাঁদের গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে এ সমাজে দলিতরা মনুষ্যপদবাচ্য নয়৷
সভ্যতার শুরু থেকেই দুর্বলের ওপর সবলের নিয়ন্ত্রণ, বিজিতের ওপর বিজয়ীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ধর্ষণ ব্যবহার করা হয়েছে হাতিয়ার হিসাবে৷ এর মধ্যে দিয়ে বিজয়ী যেন বলছে – ‘দেখো, তোমাদের নারীদের জরায়ুও এখন আমাদের দখলে৷'
পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বিষয়টিকে দেখিয়েছেন এইভাবে – ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে অন্য পুরুষদের এটা বোঝানো সম্ভব হয় যে, তাঁর সন্তানরা এ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে৷ এভাবে একটি সমাজ বা সম্প্রদায়ের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে তাঁদের দাসে পরিণত করার একটি উপায় হলো ওই সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করা, সোজা কথায় – ধর্ষণ করা৷
বাদাউনের ধর্ষকদের মনের গভীরেও হয়ত সেই দখলদারিত্ব আর ক্ষমতা প্রদর্শনের তাড়না ছিল, হয়ত সব ধর্ষকের ক্ষেত্রেই একটি পর্যায় পর্যন্ত এটা খাটে৷ আর বাদাউনের মেয়েদের বেছে নেয়া হয়েছে কারণ প্রথমত তাঁরা নারী এবং দ্বিতীয়ত তাঁরা অচ্ছুত৷
একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার জন্য ভারত সরকারও দায় এড়াতে পারে না৷ এমন হতে পারে যে দলিত এলাকাগুলোতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারছে না কারণ সেখানকার ছোট পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মানুষ এবং তাঁরা একই সমাজের বাসিন্দা৷ হয়ত এ কারণেই দলিত পরিবারগুলোর পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না, প্রয়োজনীয় টয়লেট থাকে না, দলতি সম্প্রদায়ের মেয়েদের প্রাতকৃত্য সারতে মাঠে যেতে হয়৷ আর একজন পুরুষ কতটা অসুস্থ হলে ওই অবস্থায় একজন নারীকে দেখে কামনার উদ্রেক হতে পারে?
বর্বর পাশবিকতার এই সমাজে এখন বোধ হয় শেল্ফ থেকে ‘কামসূত্র' সরিয়ে ফেলার সময় এসেছে৷ তার বদলে রাখতে হবে মেয়েদের জন্য আত্মরক্ষার কৌশল নিয়ে লেখা কুংফু শেখার বই৷
ব্লগ: মানসী গোপালকৃষ্ণণন/জেকে
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ