‘কালশীর ঘটনা হত্যা নয়...'
১৮ জুন ২০১৪সামহয়্যার ইন ব্লগে আব্দুল হালিম মিয়া লিখেছেন, যে কোনো অবস্থায় নিরীহ নারী শিশুকে হত্যা করার অধিকার কারো নেই৷ তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন৷ লিখেছেন, ‘‘১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বেরে পরে এসে দেখি বিহারীরা জোর করে দখল করে রেখেছে নয়া চাচার বাড়ি৷ উল্লেখ্য, নয়া চাচার তিন ছেলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন৷ শুনেছি, মিলিটারিরা যখন গোয়ালন্দে আসেন তখন বিহারীরা পাকিস্তানি মিলিটারিদেরকে সাথে করে নিয়ে দেখিয়ে দিতেন কারা কারা মুক্তি বাহিনীতে গেছেন, তাদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করে দিতেন৷''
তিনি লিখেছেন, ‘‘এ সব ঘটনার কারণে স্বাধীনতার পর ওরা টার্গেট হলো৷ গোয়ালন্দের মরা পদ্মায় প্রচুর লাশ ভেসেছিল, বাতাসে অনেকদিন যাবত সেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ছিল৷''
তবে তিনি বর্তমান ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘‘সেসব বিগত হয়েছে আজ থেকে ৪৩ বছর আগে৷ সে দিন যে শিশুটির জন্ম হয়েছে তার বয়স আজ ৪৩ বছর৷ এখন প্রশ্ন হলো এই যে, ওইদিন যে শিশুটির জন্ম হয়েছে তার বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কেন সে করছে? এ ঘটনা মানবতার বিরুদ্ধে জঘণ্য আর একটা অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ দুর্নীতি, খুন, গুমকে হালাল করতে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তারাই আসলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে৷ তারাই মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় শত্রু৷''
একই ব্লগে সুরেশ কুমার দাশ লিখেছেন, ‘‘বর্তমান সরকারকে জনগণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারকরা তা বুঝতে পারছে না৷ হত্যা খুনের মতো ঘটনাগুলো নৈমিত্তিক হয়ে উঠছে৷ মিরপুরের অবাঙালি কলোনিতে আগুন দিয়ে কে বা কারা একই পরিবারের ১০ জনকে পুড়িয়ে মেরেছে৷ যেখানে দু'জন শিশুও ছিল৷ বর্বরতার যেন শেষ নেই!''
‘‘ঝগড়া-বিবাদ হতেই পারে কিন্তু ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে, তালা দিয়ে পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ড মানে পরিকল্পিত ও সংগঠিত হত্যাকাণ্ড৷ কী কারণে হত্যাকারীরা রাষ্ট্রে কোনো আইন ও বিচার নেই – এমন ভাবনা লালন করে নির্ভাবনায় হত্যা-খুন ও অরাজকতায় মেতে উঠেছে তা বোধগম্য নয়৷ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চারপাশে খুনিরা অনেক বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে৷ যে যেমনভাবে পারছে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে৷ নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় যদি ইন্ডিয়া থেকে আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়, তাহলে সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যার আসামি কেন ধরা সম্ভব হয়নি – সেই প্রশ্নটাও যুক্তিযুক্ত৷''
মোহাম্মদ আসাদ আলী আমার ব্লগে লিখেছেন, ‘‘বর্বরতার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছি আমরা? তালাবদ্ধ ঘরে অগ্নিসংযোগ করে নিরীহ নারী-শিশুকে কয়লায় পরিণত করার দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে ছিল না৷ উগ্রবাদ আমাদের জাতীয় চরিত্রের সাথে কোনো কালেই খাপ খায়নি৷ সর্বমহলে বাঙালি জাতি অন্য জাতির প্রতি শান্তিপ্রিয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে৷ কিন্তু বিহারী ক্যাম্পের ঘটনাটিতে শুধু আমাদের উগ্রপন্থাই প্রকাশ পায়নি, রীতিমত দানবীয় চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে৷ নিঃসন্দেহে ঘটনাটি আমাদের জন্য অশনিসংকেত বহন করছে৷''
তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘বিহারী কা বাচ্চা, কাভি নেহি সাচ্চা'' প্রবাদটির সাথে আমাদের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে৷ এই প্রবাদটি তৈরি হবার পেছনে তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু না কিছু প্রভাব রয়েছেই৷ বিহারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে সমালোচনাটি করা হয়ে থাকে, তা হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন৷ বস্তুত একই ধর্মবিশ্বাসী হবার পরও বাঙালি মুসলিমদের সাথে বিহারীদের রয়েছে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভেদ৷ কিন্তু তাই বলে তাঁদের চার দশক আগের পূর্বপুরুষদের কৃত পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তা তো নয়৷ শুধুমাত্র এই সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভিন্নতা থেকেই এমন একটি নৃশংস ঘটনার জন্ম নেবে তা আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না৷''
ফেসবুকে রফিকুল রঞ্জু লিখেছেন, ‘কালশীর ঘটনা হত্যা নয়, গণহত্যা৷' তিনি জেনেভা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২-এর উল্লেখ করে বলেছেন, গণহত্যা হলো – ‘‘কোনো জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, সম্প্রদায় অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নীচে বর্ণিত কোনো কাজ করা৷ যেমন-
ক) ওই গোষ্ঠীর (গ্রুপের) সদস্যদের হত্যা করা;
খ) ওই গোষ্ঠীর (গ্রুপের) সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা
তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘শুধু তাই নয়, গণহত্যা করার ষড়যন্ত্র করাও গণহত্যা; গণহত্যা করার জন্য নির্দেশ দেয়া, প্রকাশ্যে উসকানি দেয়াও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা৷ এই কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে৷ কালশীতে যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা বিহারীদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই করেছে, সেটা স্পষ্ট৷''
তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘‘গত কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ্যে বিহারীদের নির্মূল করা, উচ্ছেদ করা, হত্যা করার পক্ষে বক্তব্য রেখে চলেছেন অনেকেই৷ এদের মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করে বিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷''
সংকলন: অমৃতা পারভেজ
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ