গত দুই দশকের ঘটনাবলীর দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে- দখল, কান ধরে ওঠ-বস করানো, জুতার মালা পরানো, আইন বর্হিভুতভাবে পদত্যাগ ও বহিষ্কার, হেনস্তা বা অপমানের সংস্কৃতি এক ধরনের চর্চা বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে এ ধরনের ঘটনা যেন উৎসবে রূপ নিয়েছে৷ অনেকেই একে ‘মব জাস্টিস' বলে ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ককে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে৷ অতীতে এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম চাদরে ঢাকার চেষ্টা করা হতো৷ ফলশ্রুতিতে আগের মতই গুরুতর অপরাধ এবং সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনাগুলোকে ফৌজদারি আইনের আওতায় বিচারের ব্যবস্থা না করে দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়ে অপরাধগুলোকে সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে৷ কিন্তু চাণক্যের একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার – নিমগাছ আমূল জলসিক্ত করে কিংবা দুধে ভিজিয়ে রাখলেও কখনও মধুর হয় না৷
বাংলাদেশে ৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে পাঁচবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে৷ কখনো নির্বাচনের মাধ্যমে আবার কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের মাধ্যমে৷ ক্ষমতার পালাবদলের প্রত্যেকটি ঘটনায় একটি দৃশ্য খুব সাধারণ৷ সেটি হলো সরকার পরিবর্তনের পরপরই নতুন দখলদারদের আবির্ভাব ঘটে৷ লুটতরাজ, দখল, অগ্নিসংযোগ - এগুলো নির্বাচনে পরাজিত বা ক্ষমতাচ্যুতদের ভাগ্যের সহজাত পরিণতি ছিল৷ এবারও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি৷ রাতারাতি পদত্যাগ করানো, জোর করে অফিস থেকে বের করে দেওয়া, মারধর, হুমকি, পছন্দের ব্যক্তিদের পছন্দসই পদে বসানো ইত্যকার নৈরাজ্যকর ঘটনার কোনটিই ঘটতে আর বাকি নেই৷ তবে অতীতের সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে শিক্ষকদের হেনস্তা ও অপমানের ঘটনাগুলো৷
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা পদত্যাগ করেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তাদের অব্যাহতির দাবি তোলা হয়৷ এমন দাবির মুখে কোথাও কোথাও তারা পদ ছেড়েছেন, দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন৷ কিন্তু স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা ঘটেছে তা সব ধরনের ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে৷ কোথাও শিক্ষার্থীরা আবার কোথাও বহিরাগতরা শিক্ষকদের শুধু জোর করে পদত্যাগই করাননি, জুতার মালাও গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন৷ কোথাও কোথাও শিক্ষকরা অপমান ও মানসিক পীড়ন সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ সেসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাতে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে দীর্ঘমেয়াদে ভয়ানক অবনমনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ উপর্যুপরি এসব ঘটনা ঘটতে থাকলেও প্রথমদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতে ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি৷ তবে দেরিতে হলেও ২৬ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে এমন ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের অপসারণে আইন অনুযায়ী আচার্য ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে মাউশি বদলিসহ প্রযোজ্য ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ এসব ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাঠালে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দপ্তর তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে৷ কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনার পরও ২৮ আগস্ট নওগাঁয় একই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি৷ নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নূরুল হক এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷
পাইকারি হারে শিক্ষকদের এমন অপমান ও লাঞ্ছনার ঘটনাগুলোকে অনেকেই 'মব জাস্টিসে'র পালকে ফেলে বিষয়টিকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও হয়রানির এসব ঘটনাকে সংক্ষুব্ধ মানুষের হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলা কিংবা বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখার সুযোগ নেই৷ বাংলাদেশে ২০১৬ সাল থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত নিয়মিত দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক হয়রানি ও অপমানের ঘটনা ঘটতো৷ তখন সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য, আওয়ামী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা এবং তাদের সমর্থিত গভর্নিং বডির সদস্যরা এসব করতেন৷ আর এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেই ধরনের কাজ করছেন আওয়ামী লীগ বিরোধী লোকজন৷ অতীতের ঘটনাগুলোতে যেমন শাস্তি হয়নি তেমনি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু হা-হুতাশ দেখতে পাচ্ছি৷ অতীতে শিক্ষক হয়রানির ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষকের সাম্প্রদায়িক পরিচয় ও ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো৷ এখন করা হচ্ছে মব জাস্টিসকে৷ অতীতের মতোই এসব ঘটনায় আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা দেখছি না৷ লাঞ্ছনার ঘটনায়, শিক্ষক প্রহারের ঘটনায়, বিশেষ করে সরকারি স্কুল-কলেজে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোতে সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল গুরুতর অপরাধ হিসেবে ফৌজদারি আইনে বিচারের ব্যবস্থা করা৷ অতীত এবং বর্তমান সবসময়ই এসব অপরাধকে গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে অপরাধীর হয়ে ঢালকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করা হয়েছে৷ মগজে কতটা পচন ধরলে একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হয়? একটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধকে ২০১৬ সাল থেকে বারংবার জনরোষ বলে পার করে দিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে প্রতিবার রাষ্ট্র ও সরকার কিভাবে তাদের দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারে?
২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠ-বস করানোর ঘটনায় কি স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের কোনো শাস্তি হয়েছিল? এরপর একে একে বিনা অপরাধে মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের জেল খাটা, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জুতার মামলা পরানো, আশুলিয়ায় ছাত্রের হাতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের খুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপককে হেনস্তার ঘটনাগুলো দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দিলেও ক্ষমতাসীনদের দুঃখপ্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ সবশেষ চলতি বছরে কুমিল্লা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীলীগ সমর্থিত কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে শিক্ষকরা অপমানিত হয়েছিল৷ এসব ঘটনায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি৷ প্রশাসন দোষীদের সতর্ক করেই দায় সেরেছিল৷ আমরা দেখেছিলাম শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠ-বস করে অপমানের ঘটনায় পুরো বাংলাদেশ জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল৷ 'স্যরি স্যার', ‘কান ধরে হোক প্রতিবাদ', ‘উই আর স্যরি স্যার' ইত্যাদি লেখা হ্যাশট্যাগ দিয়ে তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সরব হয়ে উঠেছিল৷ আর এবার তো সে ধরনের প্রতিবাদও চোখে পড়েনি৷ একই ধরনের আইনবিবর্জিত এবং অনৈতিক কাজ যদি বারংবার হতে থাকে, তার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে৷ প্রভাবটি হলো জনগণ ও সমাজের কাছে বিষয়টি সহনীয় হয়ে যায়, তা নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না৷
শিক্ষকদের সম্মানের এমন দূরাবস্থা হঠাৎ করে শুরু হয়নি৷ স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্মানহানির প্রক্রিয়া আর্থিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে শুরু হয়েছিল৷ এর সাথে সৈয়দ মুজতবা আলীর লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের বড়জোর একটি ঠ্যাংয়ের সমান বিবেচনার সাথে মিল আছে৷ মুজতবা আলীর পণ্ডিতমশাই গল্পের পন্ডিতের বেতন ছিল ২৫ টাকা, আর স্কুল পরিদর্শক ইংরেজ সাহেবের তিনপেয়ে কুকুরের পেছনে মাসিক খরচ হতো পঁচাত্তর টাকা৷ সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই পন্ডিত মশাই খুঁজছিলেন তার পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কয়টা ঠ্যাঙের সমান৷ আর এখনকার স্মাতক পাশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুঁজেন তাদের সম্মান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অষ্টম শ্রেণি পাশ পিয়ন ও টাইপিস্টদের চেয়ে কতটা নিচে৷ পিয়ন ও টাইপিস্টদের বেতন দেয়া হয় ১২তম গ্রেডে৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান ১৩ তম গ্রেডে, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরও নীচে৷ স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো সরকারের সময় বেতন বাড়ানোর দাবি তোলা হলে শিক্ষকদের জেয়াফতের খানা খেতে যাওয়া মিসকিনের মতো বিবেচনা করা হয়েছিল৷ এ থেকে বুঝা যায়, শিক্ষকের মর্যাদা শুধু একটি ফানুস ছাড়া আর কিছু নয়, সমাজের অভিজাত শ্রেণির কাছে বিষয়টি তামাশা ভিন্ন অন্য কিছু নয়৷ শিক্ষককে যখন দীনহীন ও করুণার পাত্র করে রাখা হয়, তখন তার মেরুদণ্ড শক্ত তো থাকেই না, উপরন্তু মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
শিক্ষকদের অপমান ও লাঞ্ছনার ঘটনাগুলো থেকে আমরা কি বার্তা পাচ্ছি? এগুলোর দায় কার? শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের নাকি সমাজ, রাষ্ট্র, ও শিক্ষাব্যবস্থার? শিক্ষকদের আজকে পাইকারি হারে যেভাবে সম্মানহানি ঘটছে এর পেছনে শিক্ষকদেরও দায় আছে৷ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিতে শুধু নামই লেখাননি, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে দলীয় লেজুড়বৃত্তিমূলক রাজনীতির জন্য পেশাদারিত্বের সবধরনের সত্তাকে বিকিয়ে দিয়েছেন৷ শিক্ষাখাতে যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, তার ফলশ্রুতিতে পাইকারি হারে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ খোলার মধ্য দিয়ে শিক্ষকের নামে যোগ্যতাহীন দলীয় ক্যাডার নিয়োগ দেয়ার এক তীব্র প্রতিযোগিতা চলে৷ পর্যায়ক্রমে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার এমন অবনমন ঘটানো হয় যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে কৃত্রিমতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লাভ-ক্ষতির হিসেব ঢুকে পড়ে৷ শিক্ষার্থীদের আত্মবোধ গড়ে দেন শিক্ষকরা৷ এর ভিত্তি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক৷ কিন্তু সে সম্পর্ক এখন প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধে রূপ নিয়েছে৷ পরিণামে একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বনাঞ্চল ভস্মীভূত হয়ে যায়, তেমনি শিক্ষকতা পেশার রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নে পুরো শিক্ষক সমাজ অপমানিত হচ্ছে৷ স্কুল কিংবা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় – যে ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক না কেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যখন স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গসংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে তখন ওই প্রতিষ্ঠানের মৃত্যুঘন্টা বাজতে শুরু করে৷ প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হলে শিক্ষকরা যে আক্রান্ত হবেন সেটি তো বলাই বাহুল্য৷
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সবশেষ সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম পেনশন বাতিল সংক্রান্ত আন্দোলন প্রসঙ্গে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, শিক্ষকরা আন্দোলন করে ক্লান্ত হলে তিনি শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসতেন৷ শিক্ষকরা কখনও ক্লান্ত হয় না৷ তারা ভাঙে, কিন্তু মচকায় না৷ কারণ শিক্ষকরা হলো বৃক্ষের মতো৷ বৃক্ষ রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়ে৷ তারপরও উঠে দাঁড়ায়৷ যে বৃক্ষ ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয় তাকে আমরা আঘাত করি, ধ্বংস করি৷ তারপরও সে বৃক্ষই একই প্রতিদান দিয়ে যায়৷ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা যেমন আমরা বুঝি না, তেমনি বৃক্ষকে সমূলে কেটে ফেলার আগে এর অভাব আমরা বুঝতে পারি না৷ শিক্ষকদের যেভাবে অপমান, অপদস্থ করা হচ্ছে তাতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোদমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলে ভয়ানক কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ শিক্ষকরা মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে ক্লাস নিতে ভয় পেতে পারে, যাতে বিজ্ঞানমনস্ক ও উদারনৈতিক আলোচনার কারণে তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন শুরু হয়ে না যায়৷ শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে স্বচ্ছতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে ইস্ততত বোধ করতে পারে, পাছে শিক্ষার্থীর অন্যায় দাবির বিরোধিতা করলে সম্মান হারাতে না হয়৷ সহপাঠি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো শিক্ষার্থীর অসংলগ্ন আচরণ ও অন্যায্য আচরণ দেখলে শিক্ষক হয়তো দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন, পাছে না আবার অবরুদ্ধ হতে হয়৷ প্রত্যেক পেশার কিছু নিজস্ব নর্মস বা মূল্যবোধ থাকে৷ শিক্ষকতার মূল্যবোধ হলো একজন শিক্ষকের কাছে প্রত্যেক শিক্ষার্থী অবশ্যই সমানভাবে বিবেচ্য হবেন৷ এটা শিক্ষার্থীর অধিকারও৷ যেই শিক্ষক নিজেই তার অধিকার পাচ্ছেন না, নিয়ত মর্যাদাহানি ঘটছে, তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীর সমানাধিকার রক্ষা করবেন?
ধারাবাহিকভাবে বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম থাকবে ভয়াবহ৷ তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান-কোটা থাকবে, শিক্ষক নামের কিছু কর্মচারীও থাকবে, বিদ্যাও থাকবে; কিন্তু শিক্ষা থাকবে না৷ কারণ, ‘বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন৷ বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে'৷ শিক্ষকরা তখন সুবাসিত বাগানের পুস্প কারিগর না হয়ে আমলা তৈরির মেশিন হয়ে যাবে৷ মূল্যবোধ হারানোর ক্ষেত্রে আমরা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি না, ক্রমাগত ভূমি হারাচ্ছি, পরাজিত হচ্ছি৷ শিক্ষকদের অপমানের এই পাইকারি বাজার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঠেকানোর যথাযথ উদ্যোগ না নিলে শুভত্ব আর বিবেচনাবোধ বলে সমাজে কিছু থাকবে না৷ বর্তমানে যা ঘটছে তা আমাদের মানসিক অন্ধকার ও লজ্জাহীনতাকে ফুটিয়ে তুলছে৷ বিবেচনাহীন সমাজে মানুষের লজ্জা থাকে না৷ লজ্জাহীন সমাজের অন্ধকার দিকগুলো দুষ্টচক্রের মতো আরো বেশি ঘনীভূত হয়৷ তখন শুধু সাপ নয়, সাপের সাথে খলের নিষ্ঠুরতাও সমাজে বাড়তে থাকে৷ মনে রাখতে হবে, সাপের চেয়ে খল অনেক বেশি নিষ্ঠুর৷ সাপকে মন্ত্র দিয়ে বশে আনা যায়, কিন্তু খলকে বশে আনা যায় না৷ শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি সমাজেরও কিন্তু দায় আছে শিক্ষকদের চলমান সঙ্কটগুলোর সমাধানে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসার৷