কেন খুলছে, কেন খুলছে না?
৫ মে ২০২০প্রশ্ন উঠেছে ঈদের শপিং চললে সবকিছু খুলে দিতে অসুবিধা কোথায়?
পোশাক কারখানা খুলেছে রপ্তানি ধরে রাখতে৷ অর্ডার যাতে আর বাতিল না হয় সেই যুক্তিতে৷ আর এবার দোকানপাট ও শপিং মল খুলছে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য৷ তবে সরকার বলছে এগুলো হবে সীমিত পরিসরে৷ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত৷ প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘‘ঈদে মানুষ একটু কেনাকাটা করবে না তা কি হয়?’’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে জানান, ‘‘শপিং মল আর দোকান আছে দেশে ৩০ লাখ৷ আর শুধু শপিং মল আছে ২৫ হাজার৷ আর সব মিলিয়ে ১৫ জন বা তার কম কর্মচারি নিয়ে কাজ করে এরকম ক্ষূদ্র ব্যবসা আছে লাখ আর মোট কর্মী এক কোটি ২০ লাখ৷ এটা বিবিএস-এর হিসাব৷ তাদের আয় উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে৷ এই ঈদকে সামনে রেখেও যদি দোকানপাট খোলা না যায় তাহলে না খেয়ে মরতে হবে৷ তাই সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
‘‘আমরা সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি মেলে শপিং মল ও দোকানপাট খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ ১০ তারিখে খুলে যাবে৷ আমরা শুধু নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানব তা নয়, ক্রেতারাও যাতে মানেন সে ব্যবস্থা করছি৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন প্রত্যাহার করে সবকিছু খুলে দেয়া হচ্ছে৷ আমরা কেন খুলব না?,’’ মন্তব্য তার৷
মসজিদ খোলার দাবি
মসজিদও খুলে দেয়ার দাবি উঠছে৷ এখন সাধারণ নামাজে পাঁচজন, জুমার নামাজে ১০ এবং তারাবিতে সর্বোচ্চ ১২ জন নামাজ আদায়ের নির্দেশ আছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘‘এখনতো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ গার্মেন্টস খুলেছে, দোকানপাট, শপিংমল খুলে যাচ্ছে তাহলে মসজিদ স্বাভাবিকভাবে খুলে দিতে অসুবিধা কোথায়? মসজিদেও মুসল্লিরা সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ আদায় করবেন৷ প্রয়োজনে অল্প সময় অবস্থান করে শুধু ফরজ নামাজ আদায় করবেন৷ এইসব শর্তে মসজিদ খুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি৷’’
পরিবহণ শ্রমিকেরা ঢাকার ভিতরে ও আন্তঃজেলা বাস চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকার গাবতলীসহ বিভিন্ন এলকায় মিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন৷ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘‘পরিবহণ শ্রমিকরা এখন বাধ্য হচ্ছেন মাঠে নামতে৷ আমাদের দেখার কেউ নেই৷ কেউ আমাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেনি৷ পেটে ভাত না থাকলে আমরা করোনা দিয়ে কী করব?’’ তিনি বলেন, ‘‘ঈদ শপিং, দোকাপাট, গার্মেন্টস খুললে আমরা কী দোষ করলাম৷আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালাবো৷ মাস্ক ব্যবহার করব৷ গাড়িতে স্যানিটাইজার রাখব৷ সামাজিত দূরত্বের জন্য যাত্রী কম নেবো৷ সারাদেশে বাস-মিনিবাসসহ যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হোক৷’’ নৌযান শ্রমিকরাও একই দাবি তুলেছেন৷
গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটির নামে করোনা প্রতিারোধে লকডাউন শুরু হয়৷ ধাপে ধাপে এটা ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ সারাদেশে জরুরি সেবা ছাড়া আর সববিকছু বন্ধের কথা বলা হয়৷ কিন্তু শুরু থেকেই সাধারণ ছুটির নামে এই লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো৷ কারণ কোনো কিছুই সঠিকভাবে মানা হচ্ছিল না৷ আর এখন এই যে কথিত সীমিত আকারে সবকিছু খুলে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে তাকে আত্মঘাতী মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷
কেন আত্মঘাতী?
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত বাড়ছে৷ এর প্রবণতা উর্ধগামী৷ গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা একদিনে সর্বোচ্চ ৭৮৬ জন৷ প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এপর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯২৯ জন৷ আর মারা গেছেন ১৮৩ জন৷ ২৪ ঘণ্টায় টেস্ট করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭১১ টি নমুনা৷
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘মহামারির নিয়ম হলো এক পর্যায়ে শীর্ষে চলে যায়৷ তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে৷ যখন কমতে থাকে তখন নিয়ম মেনে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলতে হয়৷ আমাদের এখানে করোনার যে প্রবণতা তাতে এখনো আক্রান্তে শীর্ষে যায়নি৷ এখনো বাড়ছে৷ আজকেও(মঙ্গলবার) আক্রান্ত অতীতের যেকোনো দিনের চেয়ে বেশি৷’’ তিনি বলেন, ‘‘অন্যদেশের মতো আমাদের এখানে দ্রুত পিকে যাচ্ছেনা৷ এর কারণ হলো আমাদের এখানে আমরা টেস্ট কম করছি৷ যদি প্রতিদিন ৫০হাজার চেস্ট করা যেত তাহলে আমরা পরিস্থিতি বুঝতে পারতাম৷ আমরা পরিস্থিতি না বুঝেই সবকিছু খুলে দিচ্ছি৷ এতে করোনা আরো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখছি আমি৷’’
তবে অর্থনেতিক কর্মকান্ড স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচল রাখার পক্ষে তিনি৷ আর সেটার জন্য একটি সমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনা দরকার বলে তিনি মনে কেন৷ তিনি বলেন, ‘‘পোশাক কারখানা খোলার আগে কর্মীদের এন্টিজেন ও এন্টিবডি পরক্ষার দরকার ছিলো৷ তাহলে ভাইরাস সংক্রমনের বাস্তব অবস্থা জানা যেত৷ সেটা করা হয়নি৷
‘‘লকডাউন কার্যকর করতে হলে খাবারের নিশ্চয়তা দিতে হয়৷ সরকার লাখ লাখ টন খাবার মজুদ থাকার কথা বললেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছেনা৷ মানুষ খাবার পাচ্ছেনা৷ তাই সরকার এখন সবকিছু খুলে দিয়ে এমন একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছেন যে করোনা কমে যাচ্ছে, ভয় নাই৷ এটা আত্মঘাতী,’’ বলেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ৷
ঈদের বাজারের কথা বলি কিভাবে!
আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘‘এখন করোনা একজন থেকে তিনজনে ছাড়াচ্ছে৷ কিন্তু নিয়ম হলে যখন একজন থেকে সর্বোচ্চ একজনের বেশি ছড়াবে না তখন ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করা যাবে৷ কিন্তু আমাদের এখানো তো সেই পরিস্থিতি এখনো হয়নি৷ এখানে তো আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনিয়ে গাইড লাইন আছে৷ সেখানে প্রথম শর্ত হলো সংক্রমণের হার নিম্নগামী হতে হবে৷ আর এটা হতে হবে প্রমাণ ভিত্তিক৷ একজন থেকে একজনের কম আক্রান্ত হতে হবে৷ আর ডুয়েল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থাৎ করোনা এবং করোনার বাইরের চিবিৎসা নিশ্চিত করতে হবে৷ সংক্রমণের হার যখন বাড়ছে তখন আমরা সবকিছু খুলে দিচ্ছি৷ এটা কিভাবে হয়! এখনতো আরো কড়াকড়ি করা প্রয়োজন৷’’
‘‘জরুরি অর্থনেতিক কর্মকান্ড ও সেবা এই সময়ে চালু রাখতে হবে৷ তবে তারও কিছু নিয়ম আছে৷ স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাসপাতাল খোলা আছে, সংবাদ মাধ্যম চলছে৷ প্রয়োজনে কিছু দোকানও চলতে পারে৷ কিছু যানবাহনও চলতে পারে৷ চলতে পারে আরো কিছু অর্থনেতিক কর্মকান্ড৷ কিন্তু আমরা ঈদের বাজারের কথা বলি কিভাবে! এই করোনায় ঈদ আসে কিভাবে?,’’ বলেন আইইডিসিআর-এর সাকেব এই বিজ্ঞানী৷
তিনি বলেন, ‘‘আসলে সত্যিকার লকডাউন করতে হলে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে রাষ্ট্র ও সমাজকে দাঁড়াতে হবে৷ সেই ব্যর্থতা থেকেই এখন নানা ধরনের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে৷ এর ফল খারাপ হবে৷’’
এদিকে দোকানপাট খোলা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি৷ এমনকি করোনা চিকিৎসায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে যে চিকৎসকেরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাও মন্তব্য করতে নারাজ৷ শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘এটা তো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত৷ আমি মন্তব্য করি কিভাবে?’’