খেতে হলে আধার কার্ড!
৭ মার্চ ২০১৭গত সপ্তাহে ভারতের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এক আকস্মিক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিন যে ‘মিড ডে মিল', অর্থাৎ দুপুরের খাবার দেওয়া হয়, তা খেতে হলে আধার কার্ড থাকাটা বাধ্যতামূলক৷ যাদের এখনও আধার কার্ড নেই, তাদের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে এই সরকারি পরিচয়পত্র বানিয়ে নেওয়ার জন্য৷
আধার কার্ড ভারতীয় নাগরিকদের জন্য একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন পদ্ধতি, যেখানে প্রত্যেকের জন্য আলাদা একটি নির্দিষ্ট পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যা নিশ্চিত করে দেওয়া হচ্ছে৷ সেই সংখ্যার ভিত্তিতে নথিভুক্ত হচ্ছে একেকজনের আঙুলের ছাপ এবং চোখের মনির গঠন, যা আঙুলের ছাপের মতোই প্রকৃতিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন৷ প্রথমে বলা হয়েছিল, বায়োমেট্রিক পরিচিতি সম্বলিত এই আধার সংখ্যা নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক৷ ভোট দেওয়া থেকে শুরু করে যে কোনো সরকারি কাজে এই আধার পরিচয়পত্রই ভবিষ্যতের ভারতে একমাত্র নাগরিক পরিচয় হিসেবে গণ্য হবে৷ কিন্তু পরে, পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে ভোটের মুখে জানানো হয় যে না, আধার কার্ড থাকাটা আবশ্যিক নয়৷ কিন্তু যত দিন গেছে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা, বিশেষত ভরতুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে আধার কার্ড থাকাটা কার্যত বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ যেমন জ্বালানি গ্যাসের ক্ষেত্রে যে সরকারি ভরতুকি দেওয়া হয়, তা এখন একমাত্র সরাসরি জমা পড়ছে আধার কার্ড সংযুক্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে৷ এবার মিড ডে মিলের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি চালু করতে চলেছে সরকার৷ আর তাতেই ক্ষিপ্ত বিরোধীরা৷
সবার আগে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ তিনি টুইট করেন – ‘‘এখন থেকে কি ০-৫ বছরের শিশুরও আধার কার্ড লাগবে? মিড-ডে মিল ও আইসিডিএসের জন্যও আধার কার্ড? অবিশ্বাস্য! একশ' দিনের কাজও বাদ যায়নি৷'' তাঁর প্রশ্ন, ‘‘গরিব, খেটে-খাওয়া মানুষ, আমাদের প্রিয় শিশুদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন?''
‘‘আধারের নামে মানুষের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে. এটা তো এক্সটরশান! কেন্দ্রের মনোভাব এত নেতিবাচক কেন? সারা দেশে এর প্রতিবাদ হয় উচিত৷''
এবং প্রতিবাদের শুরুটাও করে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি৷ সোমবার কলকাতায় মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছে মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসে৷ রাজ্যের অন্য দুই বিরোধী দল কংগ্রেস এবং সিপিএম-ও সমালোচনায় সরব৷
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর এটা খুব পুরনো কৌশল যে সমস্যার মূল ইস্যুগুলি থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে নতুন একটা খুচরো সমস্যা তৈরি করে ফেলা৷ এবারও তিনি তাই করছেন৷''
কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মোদী এটা করছেন৷ কিন্তু এতে শিশুরা যে স্কুলে অভুক্ত থেকে যাবে, তাদের গরিব পরিবারগুলি যে সমস্যায় পড়বে, সেটা তিনি ভাবছেন না৷''
তৃণমূল সরকারকে সমস্যায় ফেলার কথা এখানে উঠছে এই কারণেই, যে সন্দেহ এবং অভিযোগ, মিড ডে মিলের নামে আসা কেন্দ্রীয় ভরতুকির টাকা অন্য খাতে খরচ করছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার৷ যে কারণে, কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক তার নির্দেশিকায়, যাঁরা মিড ডে মিল রান্নার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদেরও আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক করেছে৷ সোজা কথায়, কেন্দ্রীয় ভরতুকির টাকা শেষ পর্যন্ত কাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে মোদী সরকার৷ সেই কারণেই বিরোধীদের আপত্তি প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়া – ‘বহ তাগাদা সত্ত্বেও আধার কার্ড করা হচ্ছে নাই বা কেন! চাপে না পড়লে লোকে কিছু করে না৷ তাই চাপ দেওয়া হচ্ছে৷ রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ে আধার কার্ড তৈরির যে কাজ মুলতবি হয়ে আছে, সেটা আবার চালু হলে কার কী ক্ষতি!'