1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘গণতন্ত্রের’ দেশে ‘আস্থাহীনতায়’ সাংবাদিকতা

২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রধান দুই জোট তো বটেই, ছোটখাট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি৷ কিন্তু কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন সাংবাদিকরা৷ অভিযোগ উঠছে ‘সেল্ফ সেন্সরের'৷ কিন্তু কেন? আমরা তো স্বাধীন৷

https://p.dw.com/p/3AXFp
Symbolbild Radiointerview
ছবি: picture alliance/dpa/J. Büttner

কিছুদিন আগে বাবা হঠাৎ প্রচণ্ড অসুস্থ হওয়ায় সিলেট থেকে জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আনা হয়৷ তবে এরপরই আমাকে মুখোমুখি হতে হয় অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার৷ ঢাকা শহর সম্পর্কে বাবা-মা তেমন একটা ওয়াকিবহাল না৷

ফলে যদি কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয়, তাই এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তাঁর পরিচিত এক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলাম৷ সেই ডাক্তার যথাসাধ্য শ্রমও দিলেন তাঁদের ভর্তির সব ব্যবস্থা করতে৷ অথচ তাঁরা ভর্তি হতে পারলেন দু'দিন পর৷ পরে শুনলাম, তিনি ‘অন্যপন্থি' হওয়ার কারণেই নাকি রোগী ভর্তি হয়নি এই দু'দিন৷

ভাবুন বিষয়টা, মরণাপন্ন অবস্থাতে ডাক্তার খোঁজার সময়ও ভাবতে হবে সেই ডাক্তার কোন আদর্শে বিশ্বাসী৷

একই অবস্থা ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের সব পেশাতেই৷ ব্যক্তি পর্যায়ে কোনো একটা মতবাদে বিশ্বাস করা, নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার৷ কিন্তু সেবাক্ষেত্রে এর প্রতিফলন কি আমরা ঘটাতে পারি? সাংবাদিকরা কী বলেন? শুধু আমার পছন্দ বলে কারো অন্যায় কাজে ছাড়, আবার কারো বিরুদ্ধে একটু বাড়িয়ে বলা ‘জার্নালিজমের এথিক্সে' পড়ে?

ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনের ‘খামোশ'কাণ্ডের পর অনেকেই তাঁর এমন আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন৷ একজন সাংবাদিক হিসেবে নিন্দা জানানোদের দলে ছিলাম আমিও৷

শুধু রাজনীতিবিদ না, কেউই একজন সাংবাদিককে তাঁর ‘যৌক্তিক' প্রশ্নের কারণে ‘দেখে নেয়ার' হুমকি দিতে পারেন না, ‘কত টাকা খেয়েছো' টাইপের প্রশ্ন করতে পারেন না৷ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা জামায়াতে ইসলামীর সাথে সখ্য নিয়ে প্রশ্নটা ‘১৪ই ডিসেম্বর, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং ড. কামাল হোসেন’ বিবেচনায় আমার মতে স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ছিল৷

ফলে এমন প্রশ্নের উত্তেরে তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার কাছে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না' টাইপেরই মনে হয়েছে৷

কিন্তু আজকের লেখা সে বিষয়ে না৷ ড. কামালের মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে৷ আর সেটি হলো, ‘‘সাংবাদিকরা তো দলকানা, তাই শুধু একপাক্ষিক প্রশ্ন করে৷''

এ অভিযোগ শতভাগ সত্য কিনা, তা জানার কোনো মাপকাঠি আমার কাছে নেই, তবে সন্দেহ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে৷ ড. কামালের কাছে ‘খামোশ' হওয়া সাংবাদিক তাঁর ‘সাহসের' জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘অভয়' পেয়েছেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সে ছবি আমরা দেখেছি৷

কিন্তু শত শত সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার কোনো বিচার আমরা দেখিনি৷ সাগর-রুনি হত্যার বিচার তো প্রায় রূপকথার গল্পে পরিণত হয়েছে৷ সবশেষ উদাহরণ হিসেবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ‘হেলমেটবাহিনীর' রড-লাঠি হাতে আক্রমণে এক ফটোসাংবাদিকের মাথা থেকে রক্ত ঝরলেও, এতদিনেও তাদের গ্রেপ্তারের কোনো সংবাদ সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাছে আসেনি৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

ফলে কেউ বলে না দিলেও সাংবাদিকরা এতদিনে নিজের অজান্তে, বলতে গেলে ‘অবচেতন মনে' জেনে নিয়েছেন, কোন পরিস্থিতিতে, কাকে কোন প্রশ্ন ‘নির্ভয়ে' করা যাবে, অথবা কখন কোন প্রশ্ন কাকে করলে ‘সমূহ বিপদের' আশংকা রয়েছে৷

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন তো একটা মজার বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷ সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন তো প্রায় ‘জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের' পর্যায়ে চলে গিয়েছিল৷ নামে সংবাদ সম্মেলন হলেও তাতে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগই পেতেন না৷

আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা এমন সব প্রশ্ন করেন, যা প্রশ্নের চেয়ে ‘তৈলমর্দনই' বেশি মনে হয়৷ এটা আমার কথা না, যে-কোনো সংবাদ সম্মেলন শেষে সব মতের মানুষের সাথে কথা বললে তাঁদের কাছ থেকেই এমন অনুভূতির কথা জানা যাওয়ার কথা৷

সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও গণমাধ্যমে ‘অনৈতিক চাপ প্রয়োগের’ পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে৷ তারপরও আমি সাংবাদিকদের দায়ই দেখি বেশি৷

‘জাতির বিবেক’ হিসেবে যেখানে তাঁদের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে নানা সুবিধার বিনিময়ে হয়ত ‘চাপ প্রয়োগের’ সুযোগটা হয় তাঁরাই তৈরি করে দিচ্ছেন, অথবা মেনে নিচ্ছেন৷

ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম৷ শুধু সাংবাদিক না, আমার বন্ধুত্বের তালিকায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ থাকায় ভালোই সাড়া মিলেছে৷ কিন্তু জবাবটা হতাশাজনক৷ প্রশ্ন ছিল তিনটি-

১) এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা 'নির্ভয়ে' কাজ করছেন?

২) কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ‘চাপ' কি সাংবাদিকদের ওপর নেই?

৩) সাংবাদিকরা সত্যিকার অর্থে 'নিরপেক্ষভাবে' সংবাদ পরিবেশন করতে পারছেন?

পোস্টে উত্তরদাতাদের অধিকাংশই মনে করেন, নির্ভয়ে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পরিবেশ বাংলাদেশে নেই৷

কিন্তু নূসরাত হক, মোর্শেদ হাসিব হাসানসহ বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত তরুণ সাংবাদিকদের কেউ এর চেয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি৷ চাপ ‘আছে' বলতে কী বুঝাচ্ছেন, না বললেও তাঁদের মধ্যে ভয়টা টের পাওয়া গেছে ঠিকই৷

দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু গণমাধ্যমে কাজ করে আসা সাংবাদিক মারুফ মল্লিক বর্তমানে জার্মানিতে বাস করেন৷ তাঁর মন্তব্যে মিললো কিছুটা বিস্তারিত উত্তর৷

অনেকে অবশ্য মনে করছেন, সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবেই সরকারের সমালোচনা করছেন, কোনো বাধা নেই৷ সাংবাদিক মাহমুদ শাওনের মন্তব্য এক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য৷

তাঁর এই ছোট্ট মন্তব্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রকৃত দুরবস্থা৷ প্রথমত, উপমহাদেশের সাংবাদিকদের স্বাধীনতাকে তিনি অন্য অনেক অঞ্চলের চেয়ে আলাদা করে দেখছেন৷ দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকরা নিজেরাই চাপ নিচ্ছেন বলে তাঁর সাথে একমত মুকিমুল আহসান হিমেলও৷

কিন্তু এই সেলফ সেন্সরশিপ কেন? প্রেসক্লাবের দিকে তাকান, অন্য সাংবাদিক সংগঠনগুলোর দিকে তাকান৷ অমুক অথবা তমুক পন্থিতে ভাগ হয়ে সাংবাদিকরা এখন যেভাবে নানা পদের জন্য লড়াই করছেন, তাতে এর উত্তর হয়ত কিছুটা মিলতেও পারে৷

তাতেও সন্তুষ্ট না হলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের মালিকদের দিকে, বা বড় সাংবাদিক নেতাদের দিকে তাকান৷ দেখবেন তাঁদের অনেকেই নির্বাচনে নানা মার্কায় বিভক্ত হয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াইয়ে আছেন৷ প্রশ্ন হলো, একই সাথে দলীয় আদর্শ প্রচার ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কি সম্ভব?

আমি একটি গণমাধ্যমের মালিক হয়ে ‘অমুক মার্কা' নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালে সেই গণমাধ্যমের কর্মীদের পক্ষে ‘অমুক মার্কার' কোনো অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করা সম্ভব? এর উত্তরে কেউ গায়ের জোরে ‘হ্যাঁ, সম্ভব' বলতেই পারেন, তবে সেটা শুনে পরবর্তীতে তাঁর নিজেরই হাসি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট৷

এ বিষয়ে একটি ছোটখাট জরিপ চালিয়েছিলাম ফেসবুকে৷ ১০০ জন ভোটদাতার ৮৯ শতাংশই মনে করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পরিবেশ নেই৷ উত্তরদাতাদের মধ্যে সাংবাদিক যেমন আছেন, আছেন সাবেক কূটনীতিক, ডাক্তার, এমনকি খেটে খাওয়া মানুষও৷

এত ছোট পরিসরে এমন ব্যক্তিগত জরিপ কিছুই প্রমাণ করে না, এটা যেমন সত্যি, সাংবাদিকদের ওপর জনগণের আস্থার সংকটও সত্যি৷ ড. কামাল হোসেনের মতো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' না হলেও সাধারণ জনগণও এখন মনে করেন, যে-কোনো সংবাদেরই কোনো একটা উদ্দেশ্য রয়েছে৷

অনেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পক্ষ নেয়ার বিষয়টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেশটিতে নির্বাচনের আগেই গণমাধ্যমগুলো স্পষ্ট অবস্থান পাঠকদের জানিয়ে দেয়৷ ফলে পাঠকদের প্রতারিত হওয়ার আশংকা থাকে না৷

কিন্তু এর সাথে একদিকে ‘নিরপেক্ষতার ভান' ধরে অন্যদিকে দলের রাজনীতি করাকে না মেলানোই ভালো৷ এতে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই সংবাদ প্রকাশে ব্যক্তিমতের চেয়ে সাংবাদিকতার আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দেন, তাঁদের ক্ষতি হওয়ার শংকা বেশি থাকে৷

আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ, এরপরই রাষ্ট্রের অলিখিত চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে গণমাধ্যমকে৷ ঘুণে পুরোপুরি খেয়ে ফেলার আগে স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী না করে তুললে, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রটাই হয়ত একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য