1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিভারত

গদি, চটি, খামের সাংবাদিকতা এবং সততা

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ
৫ জুলাই ২০২৪

সাংবাদিক মানেই কী ক্ষমতা বা খামের লোভ? সবাই কি একই দোষে দুষ্ট? ক্ষমতাসীন বা আমজনতা সাংবাদিকদের কী চোখে দেখেন?

https://p.dw.com/p/4hu10
গত বছর সাংবাদিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ দিল্লিতে প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ
স্বাধীন সাংবাদিকতার ইনডেক্সে ভারতের স্থান এখন ১৬০ এর মধ্যে ১৪ছবি: Newslaundry

সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটি শুরু করা যাক। প্রাক-নির্বাচনী খবর সংগ্রহের জন্য় তখন আমরা আসামে। প্রতিদিনই সাক্ষাৎকারের জন্য় মুখোমুখি হচ্ছি কোনো না কোনো হেভিওয়েট নেতার। এবং প্রতিদিনই সাক্ষাৎকারের পর নেতারা নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি খাম হাতে ধরানোর চেষ্টা করছেন। কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্ন বাদ দেওয়ার জন্য় যে তারা একাজ করছেন, এমন নয়। এটাই নাকি সেখানে নেতার সঙ্গে সাংবাদিকের স্বাভাবিক সম্পর্ক। এবং এভাবে চলতে চলতেই একদিন নেতার 'নমক হারাম' হয়ে ওঠেন সাংবাদিক। নেতার বিরুদ্ধে আর কোনো স্বর সামনে আসে না।

আশ্চর্য হয়েছিলাম এই ঘটনায়। প্রায় ১৯ বছরের সাংবাদিকতা পেশায় খামের মুখোমুখি যে এই প্রথম হয়েছি, এমন নয়। নেতা-মন্ত্রী-অফিসার-- খামের অফার এসেছে অনেকের থেকেই। কিন্তু এবারের মতো এত খুল্লামখুল্লা নয়। একটু রেখেঢেকে। পরিবেশ নিয়ে খবর করার জেরে শিল্পপতি-গোছের ডেভেলপার সস্তায় ফ্ল্য়াটের অফারও দিয়েছেন। কিন্তু আসামে গিয়ে এবার যা দেখলাম, তার ধারেকাছে কিছু নেই।

এ নিয়ে আসামের এক পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, উপায় কী? স্থানীয় স্ট্রিংগার, করসপনডেন্টদের ইদানীং টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে পত্রিকা অফিসগুলি। কারণ, অফিসও জানে, নেতারাই টাকা দিয়ে পুসিয়ে দেবেন তাদের পারিশ্রমিক। বিষয়টি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যে নেতা যত বেশি অর্থ খরচ করেন, সাংবাদিকেরাও তার আশপাশে মৌমাছির মতো জমা হতে থাকেন। আর স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ সেই নেতার বশংবদে পরিণত হন। বিরুদ্ধ খবরের রাস্তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

আসামের কিছু সাংবাদিককে দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই। সার্বিকভাবেই ভারতীয় মূলস্রোতের সংবাদমাধ্য়মের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মূলস্রোতের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এখন নির্দিষ্ট কিছু শিল্পগোষ্ঠীর টাকায় চলে। অভিযোগ, সেই শিল্পগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে রাজনৈতিক দল এবং দলীয় নেতাদের। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে সরাসরি বিনিয়োগ আছে রাজনৈতিক নেতাদের। যেখানে সরাসরি নেই, সেখানে প্রভাব আছে। ফলে বাস্তবে সংবাদের সত্য়তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে।

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৬ সালে আচমকাই এক সন্ধ্যায় নরেন্দ্র মোদী নোটবন্দি ঘোষণা করলেন। অর্থাৎ, সমস্ত পাঁচশ এবং হাজার টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হওয়ার ঘোষণা। গোটা দেশজুড়ে তখন তোলপাড় চলছে। ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের মৃত্য়ু হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের কোনো কোনো সাংবাদিক রীতিমতো শো করে বলতে শুরু করলেন, নতুন যে দু-হাজার টাকার নোট আসছে, তাতে ন্য়ানো চিপ বসানো আছে। সেই চিপই নাকি ধরে ফেলবে নোটের বেআইনি লেনদেন। এই খবর প্রচার হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাজমাধ্য়মে তা ভাইরাল হয়ে গেল। নোটবন্দিতে জেরবার মানুষের মোবাইলে মোবাইলে পৌঁছে গেল সেই খবর। মানুষের মনে এক 'ভুয়া' আশার সঞ্চার হলো। এর বেশ কিছুদিন পর সত্য়ি সত্য়ি যখন নতুন দু-হাজারি নোট বাজারে এলো, দেখা গেল, ন্য়ানো চিপের নামগন্ধও তাতে নেই। থাকবে না, সে-ই তো স্বাভাবিক! কিন্তু ততদিনে নোটবন্দি পরিপন্থী যে মনোভাব ক্রমশ সমাজে ছড়িয়ে পড়ছিল, তা স্তিমিত হয়ে গেছে।

কে করালো এই কাজ? এই প্রশ্নের খানিকটা উত্তর মিলবে সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনের বুথ ফেরত সমীক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার মধ্যে। প্রায় প্রতিটি মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম তাদের বুথ ফেরত সমীক্ষায় বিপুল ভোটে জয়ী ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপিকে। অথচ মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়ানো সাংবাদিকেরা অনেকেই বলছিলেন, বাস্তব চিত্র মোটেই তেমন নয়। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেও দেখা গেল, বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে বাস্তবের কার্যত কোনো মিল নেই। এমন নয় যে বুথ ফেরত সমীক্ষা এই প্রথম ভুল প্রমাণিত হলো। কোনো কোনো সংস্থার বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল এর আগেও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের প্রায় প্রতিটি সংস্থা এবং মূলস্রোতের গণমাধ্যমের বুথ ফেরত সমীক্ষার একটি নির্দিষ্ট প্য়াটার্ন ছিল। যা প্রমাণ করে, এ কোনো সাধারণ ভুল নয়, এর পিছনে ষড়যন্ত্র আছে। নোটবন্দির সময়েও এমন ষড়যন্ত্রমূলক সাংবাদিকতার ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে এসেছিল। ঠিক যেমন এসেছিল কোভিডকালে।

সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে কিছু সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে এক সাংবাদিকের ফোনের কথপোকথনও প্রকাশ্যে এসেছে। অভিযোগ, একটি খবর চেপে দিয়ে আরেকটি ভুয়া খবর প্রচারের চক্রান্ত চলছিল। ডিল হয়েছিল দু-কোটি টাকার। যে কথপোকথনের রেকর্ডিং সামনে এসেছে, তাতে সাংবাদিক পুলিশকে বলছেন, টাকা তার হাতে আসেনি। আর পুলিশ বলছে, টাকা দেয়া হয়ে গেছে। এমন হাজার হাজার ঘটনা প্রতিদিন ভারতের কোনো না কোনো প্রান্তে ঘটছে। যার অধিকাংশই সামনে আসে না।

সামনে আসে না, সংবাদসংস্থার মালিকের সঙ্গে সরকারের কথপকথন। মনে রাখতে হবে, ভারতের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমই বেসরকারি। তাদের রেভেনিউ বা আয়ের একটি বড় অঙ্ক আসে রাজ্য় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপন থেকে। পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক মহলে একটি পরিচিত লব্জ হলো সরকারি বিজ্ঞাপন। রাজ্য় সরকার তৃণমূলের বিরুদ্ধে খবর করলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে, এমন কথা আকছাড় শোনা যায় নিউজ রুমের বৈঠকে। আর সেখান থেকেই ঠিক হয় খবরের 'লাইন'। খবর সরকারপন্থি হবে, নাকি বিরোধী? তৃণমূলপন্থি হলে সরকারি দলের কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হবে, বিরোধী হলে বিরোধীদলের। কিন্তু 'কৃপাদৃষ্টি' প্রয়োজন। যা না পেলে সংবাদমাধ্যমের রেভেনিউ উঠবে না।

আগে সমাজমাধ্য়ম ছিল না। তা-ই রাখঢাক বেশি ছিল। এখন সবই খুব খোলামেলা। সাধারণ মানুষ জানেন, কোন সংবাদমাধ্য়ম কোন দলের দলের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। তা-ই সমাজমাধ্য়মে তারা কারো নাম দিয়েছে গদি মিডিয়া অর্থাৎ, যারা মোদীপন্থি। কারও নাম চটি মিডিয়া অর্থাৎ, যারা মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়পন্থি। মমতা হাওয়াই চটি পরেন, সেখান থেকেই চটি মিডিয়া নামের উৎপত্তি। ভারতের অন্য় রাজ্য়গুলিতে এমন আরো মিডিয়া আছে, যারা সেই সেই রাজ্য়ের রাজ্য় সরকারের বশংবদে পরিণত হয়েছে।

স্বাধীন সাংবাদিকতার ইনডেক্সে ভারতের স্থান এখন ১৬০ এর মধ্যে ১৪০। এই ইনডেক্স থেকেই স্পষ্ট হয়, ব্য়ক্তিগত এবং সমষ্টিগত খাম বিনিময়ের কোন স্তরে বিরাজ করছে ভারতীয় সাংবাদিকতা। কিন্তু এইটুকু বলে ছেড়ে দিলে সত্য়ের অপলাপ হবে।

এর পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে গত কয়েক দশকে শুধুমাত্র সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কতজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিক মহলে তাদের 'শহিদ' বললেও অত্য়ুক্তি হবে না। খবরের সৈনিক হিসেবেই মৃত্য়ুবরণ করেছেন তারা, আপস করেননি। খেয়াল রাখতে হবে, খবরের মৌচাকে ঢিল মেরে কতজন সাংবাদিককে রাষ্ট্রের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। আপসের সাংবাদিকতা যদি একটি মেরু হয়, তাহলে আপসহীন সাংবাদিকতার মেরুটিও কিন্তু কম জোরদার নয়। মূলস্রোতে সাংবাদিকতা করেও আপসহীন লড়াই লড়ছেন, এমন সাংবাদিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পাশাপাশি সমান্তরাল সাংবাদের বিরাট মঞ্চ তৈরি হয়েছে ভারতে। মূলস্রোতকে যারা এখন প্রতিদিন প্রতিযোগিতার সামনে এনে ফেলছে। লড়াই হচ্ছে। লড়াই চলতেই থাকবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের মজাই হলো তার বৈচিত্রময় চরিত্র। ভারতীয় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য়। সেখানেও বৈচিত্র অনেক। আপস এবং আপসহীন চরিত্র সেখানে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে সদাবিদ্য়মান।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান