গরম গরম সিজনাল আলোচনা শুধু!
২৬ এপ্রিল ২০২৪মানুষের স্বভাব ভিন্ন৷ মানুষ গরম গরমই খেতে চায়৷ কিন্তু প্রকৃতি এখন যেভাবে গরম হয়ে উঠেছে তাতে মানুষের স্বভাবও পাল্টে যাচ্ছে৷ ঠাণ্ডা হাওয়া ও ঠাণ্ডা পানীয়ের মতো প্রকৃতির শীতলতা এখন বাংলাদেশের মানুষের একান্ত কাম্য৷ প্রকৃতির গরম আরো বেশি আঁচ করা যায় সামাজিক অন্তর্জালের ভাইরাল দুনিয়ায়৷ বৈশাখের শুরুতে প্রকৃতিতে গরমের তীব্রতা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে শোরগোল ফেলে দিয়েছে৷ নানা ধরনের ট্রলের পাশাপাশি কার চেয়ে কে কত বেশি গাছ লাগিয়ে প্রকৃতিবান্ধব হতে পারে সে প্রতিযোগিতার প্রদর্শনী সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দেখা যাচ্ছে৷ অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, শুধু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রকৃতি অনেক অভিমানে ফুঁসছে, বাড়ছে তাপমাত্রা৷ গরমের মৌসুম এলে গত কয়েক বছরে আমরা গণমাধ্যমকেও 'উহ', ‘আহ' সংক্রান্ত খবর প্রচারে অস্থির হয়ে উঠতে দেখছি৷ গরমে কীভাবে ভাল থাকবেন, কেমন পোশাক পরিধান করবেন, নায়ক-নায়িকারা কী কী খেয়ে শরীর ফিট রাখেন, গরমে কেমন মেকআপ করলে আপনাকে সুন্দর দেখাবে, হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে কী কী করবেন ইত্যকার উপদেশমূলক খবরের যোগান প্রকৃতিতে তাপমাত্রা বাড়ার পারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বা কমে৷ চিড়িয়াখানার পশুদের গা ভেজানো থেকে শুরু করে দুঃস্থ শিশুদের পুকুরস্নান গণমাধ্যমের অতি মূল্যবান নিউজহোলে এই গরমকালেই শুধু জায়গা পায়৷
গত এক দশক ধরে খবরের ফেরিওয়ালারা বাংলাদেশের পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে অনেক অশনি সঙ্কেতের খবর দিয়ে আসছে৷আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশারদদের নানা গবেষণাকর্মের রেফারেন্স টেনে গণমাধ্যম আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করছে ফিবছর৷ এসব গবেষণা কর্মের সারবস্তু হলো, প্রতি বছর গরমের মাত্রা বাড়ার পাশাপাশি প্রকৃতির আচরণের অস্বাভাবিকতাও বাড়ছে৷ যেমন, ২০২৩ সাল বিশ্বের উষ্ণতম বছর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল৷ চলতি বছর যে বাংলাদেশে গরমের তীব্রতা আরও বাড়বে এমন খবর গত বছরের জুনেই আমরা পেয়েছিলাম৷ গরমকালের এসব গরম খবরে আমরা সাময়িক অস্থির হয়ে উঠি৷ গত দু'এক বছরে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে প্রতিকারমূলক কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি৷ তারপর হঠাৎ করে আসা কালবৈশাখী ঝড়ে আবার সব ভুলে যায়, বৃষ্টি আমাদের সব অস্থিরতা ধুঁয়ে নিয়ে যায়৷ সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভাইরাল প্রজাতিরা তখন প্রশান্তিকর বৃষ্টির গুণগানে মগ্ন হয়ে পড়ে৷ পাল্টে যায় ভাইরাল দুনিয়ার আলোচ্য বিষয়৷
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিসেস এর (সিইজিআইএস) তথ্যানুযায়ী, গত তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ৷ ‘চেঞ্জেস ইন হিউম্যান ডিসকমফোর্ট অ্যান্ড ইটস ড্রাইভার ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এক গবেষণায় ছয় দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, ১৯৬১ সালে ঢাকায় সারা বছরে ৮০টি আরামদায়ক দিনের বিপরীতে তীব্র গরমের দিনের সংখ্যা ছিল ৭৷ ২০২০ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬৬ ও ২১৷ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা, বদলাচ্ছে আবহাওয়া৷ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে৷ জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসি‘র বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ০.৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ০.৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে৷ ২০৫০ সাল নাগাদ এটি বেড়ে হতে পারে ২ ডিগ্রি৷ এমন অবস্থায় বাংলাদেশে বাড়বে খরা, অতিবৃষ্টি ও তাপদাহ৷ অর্থাৎ বাড়বে দুর্যোগের সংখ্যা ও এর মাত্রা৷
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোকে মোটা দাগে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এই তিনভাগে ভাগ করা যায়৷ কিন্তু বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক উষ্ণতা ঠেকাতে করণীয় বিষয়টি যেমন একটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয় তেমনি বাংলাদেশেও এক্ষেত্রে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রচেষ্টা আমরা দেখে থাকি৷ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণগুলোকে যতটা জোর গলায় প্রচার করে থাকি, স্থানীয় কারণগুলো তার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করিনা৷ কারণটা রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বলয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট৷
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা একমত যে, বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর জলবায়ুকে উষ্ণ করছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপমাত্রা বাড়ছে৷ তাপমাত্রা বাড়ায় বাতাসে জলীয়বাষ্প বাড়ছে, পরিণামে আর্দ্রতা, বেশি অনুভূত হচ্ছে গরম৷ এরজন্য সিংহভাগে দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পরিবেশবিমুখ শিল্পায়ন ও উন্নয়ন নীতি এবং কার্যক্রম৷ ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫° সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সীমিত রাখার অঙ্গীকার পালনে উন্নত দেশগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না৷ এর আগে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমিত রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা কাজে আসেনি৷ উন্নত দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীর্ষ ১০ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে৷ আবার ভারত, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও চীন অঞ্চলে বহু নদী দখলের কারণে এই অঞ্চলটিতে তাপমাত্রা বাড়ছে৷ এটিকে এই তাপমাত্রা বাড়ার আঞ্চলিক কারণ হিসেবেই বিশেষজ্ঞরা দেখছেন৷ কিন্তু শুধুই কি এই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক আচরণ বাড়ছে? গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক কারণের পাশাপাশি স্থানীয় কারণগুলোর প্রতি অবহেলা এর পেছনে কোনো অংশে কম দায়ী নয়৷ উপরন্তু এই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে আমাদের পক্ষে তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়৷ বরঞ্চ স্থানীয় কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারতাম৷
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তাপমাত্রার বাড়ার জন্য পাঁচটি স্থানীয় কারণের ওপর বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বারোপ করে থাকেন৷ এগুলো হলো বনায়ন ও সবুজায়ন ধ্বংস, জলাধারের পরিমাণ কমে যাওয়া, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা, পরিবেশবিমুখ সড়ক ব্যবস্থা এবং নতুন নতুন বহুতল ভবনে মাত্রাতিরিক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও অতিরিক্ত গ্লাসের ব্যবহার৷ এই কারণগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নয়ন নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট৷ এসব কারণে গত কয়েক দশকে যে নিয়ত দূষণের বিস্তার আমরা ঘটিয়ে চলেছিল তার অনিবার্য ফল হলো আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ৷
সারা বছর ধরে উন্নয়ন আর নগরায়নের নামে বন ধ্বংস ও জলাধার ধ্বংস করলেও আমরা ভ্রুক্ষেপ করি না৷ কিন্তু গরম বাড়লেই আমাদের হালআমলের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃক্ষ নিধনের জন্য বিলাপ আর সামাজিক মাধ্যমে গাছ লাগানোর নছিহত৷ বনভূমি রক্ষা আর রাজনৈতিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এক জিনিস নয়৷ ছাদবাগান করে আর সড়কের ডিভাইডারে কিছু গাছ লাগিয়ে এডিস মশার প্রকোপ বাড়ানো যেতে পারে৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর যেখানে ০.৩৮ হেক্টর বনভূমি ছিল সেখানে এখন মাত্র ০.০২ হেক্টর বনভূমি অবশিষ্ট থাকার কারণ ও এর প্রতিকারে কোন বিপ্লব দেখা যায় না৷ জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বনভূমি হলো পৃথিবীর ফুসফুস৷ বছরের পর বছর ধরে ফুসফুসের ক্ষতি করে গাছ লাগানোর জন্য মায়াকান্না দেখানোটা মাথায় লাথি দিয়ে টুপিকে সালাম করার শামিল৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারিদিকে তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন– মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে৷” বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার হাওয়া হয়ে গেছে৷ বর্তমানে ঢাকায় মাত্র ২.৯১ শতাংশ জলাধার ও ৭.৯ শতাংশ সবুজ রয়েছে৷ জলাধারগুলো মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে যাতে বাড়ছে তাপমাত্রা৷ বৃটিশ টপোগ্রাফিক সার্ভে অনুযায়ী, একশ বছর আগে ঢাকায় পুকুর ছিল ১২০টি, সেখানে এখন আছে মাত্র ২৪টি৷ বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বনভূমি উজাড়কারী ও জলাধার দখলকারীদেরএকজনকেও আমরা শাস্তি দিতে পেরেছি? মন কোনো উদাহরণ কি প্রতিষ্ঠিত করা গেছে, যা থেকে দেশের মানুষের কাছে প্রতীয়মান হতে পারে জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া একটি খাত? সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পরিবহন ব্যবস্থায় কোনো শৃঙ্খলা আনতে পারছে না৷ ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর ১৫ লাখ গাড়ির ইঞ্জিন পরিবেশ উত্তপ্ত করতে যথেষ্ট দায়ী হলেও তা নিয়ে যোগাযোগ ও পরিবেশ কোনো মন্ত্রণালয়ের মনোবেদনা আমরা দেখতে পাই না৷ জলাভূমি ধ্বংস করে ফেলায় নগরে ভবনের ভেতর শীতল থাকার প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে এসি, যা পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে জ্যামিতিক হারে৷ পাশাপাশি কংক্রিটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে কয়েকগুণ৷ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো শহর এলাকায় যেখানে শতকরা ৪০ শতাংশ কংক্রিটের পরিমাণ থাকতে পারে সেখানে ঢাকার বেশিরভাগ জায়গায় কংক্রিটের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ৷
সম্প্রতি ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ঢাকায় বছরে ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে, যা ২০৫০ সালে দাঁড়াবে ৮৪০০ কোটি ডলার৷ অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির ১৭.৬ শতাংশ৷ 'বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু: আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা ও পরিবর্তন' শীর্ষক এক গবেষণায় গত ৪৩ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, তাপমাত্রা একদিকে যেমন আগের তুলনায় বাড়ছে তেমনি অন্যদিকে তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷ আগে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গরম বেশি পড়লেও এখন তা অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷ এই গবেষণায় তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিকতার মূল কারণ হিসেবে দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷
উষ্ণতা বৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক সমস্যা৷ এ সমস্যার বিরুদ্ধে লড়তে বিশ্বের অনেক দেশ ও নগর কর্তৃপক্ষ প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়ামূলক (প্রোঅ্যাকটিভ ও রিঅ্যাকটিভ) – দু'ধরনের কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে শুধুই কিছু প্রতিক্রিয়ামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে পরিস্থিতির সাময়িক সামাল দেয়ার চেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ গরমের কারণে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া কোনো স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী সমাধান হতে পারে না৷ তাপমাত্রাকে বিবেচনায় নিয়ে দিনের কোন সময়ে স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালত খোলা রাখা যায় সে চিন্তা করতে হবে৷ প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে শহরে স্বাস্থ্যসম্মত সবুজ পরিসর বাড়ানো, বনায়ন ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার এবং রক্ষা করার পাশাপাশি নতুন জলাধার তৈরি করতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথের ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর'- পুরোপুরিভাবে সম্ভব না হলেও যেটুকু আছে তাকে রক্ষায় কঠিন হতে হবে৷ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, গ্রিস, জাপান ও নেদারল্যান্ডের অনেক শহরে সবুজ ছাদ ও দেয়ালের ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে৷ পরিবেশ উপযোগী করে নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে৷ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে এনে বিভিন্ন ধরনের পিক-সেভিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে৷ ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে বিদ্যুৎ চালিত গণপরিবহন এবং হাঁটার উপযোগী ফুটপাতের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে৷ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকরের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত সবার আগে জরুরি৷ নগরায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব মাস্টারপ্ল্যানের কথা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে জোর গলায় শুনে থাকি৷ কিন্তু রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাছে উন্নয়ন হলো যেনতেনভাবে দৃশ্যমান অবকাঠামোর সংখ্যা বাড়ানো৷ রাজনৈতিক সফলতা দাবি করতে মানুষের চাহিদা পূরণে চলছে যেনতেন উন্নয়নের মিছিল৷ ক্ষমতাবানরা চান প্রকল্প আর প্রকল্পের নামে অর্থ খরচের বহুমুখী খাতের বিস্তার৷ রাজনৈতিকভাবে তীব্র তাপদাহকে কেবল আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হিসেবেই দেখছি৷ কিন্তু স্থানীয়ভাবে পরিবেশ সংরক্ষণে চরম ব্যর্থতা ও পরিবেশের প্রতি রাজনৈতিকভাবে আমাদের বৈরী আচরণকে কখনেই আমলে নিচ্ছি না৷ এমন অবহেলায় দিন যতই যাচ্ছে প্রকৃতি ততই বিরূপ হচ্ছে৷ মনে রাখতে হবে, গাই বাছুর ঠিক থাকলে দুধের অভাব হয় না৷ পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিকভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে৷ রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই বলে গেছেন, ”প্রকৃতিতে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তার পরে আসে বিনাশের পালা৷ …কৃত্রিম ব্যবস্থায় মানবসমাজের সর্বত্রই এই-যে প্রাণশোষণকারী বিদীর্ণতা এনেছে, একদিন মানুষকে এর মূল্য শোধ করতে দেউলে হতে হবে৷ সেই দিন নিকটে এল…৷”