গেজেটেরও কান আছে
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বন্ধ ফোনও কথা শোনে৷ বছর তিনেক আগে অ্যামেরিকা ফেরত এক বন্ধু আচমকা বলেছিল কথাটা৷ টেকনোলজি নিয়ে আগ্রহ কম৷ তাই বিষয়টি আরো অনেকের জানা হলেও, আমার জানা ছিল না৷ বন্ধু ওই মন্তব্যের পর হাতেকলমে প্রমাণ দিতে শুরু করলো৷
হাতের পাশে ফোন রেখে আমরা নানা প্রোডাক্টের গল্প শুরু করলাম৷ অমুক ব্র্যান্ডের গাড়ি, তমুক ব্র্যান্ডের জিন্স ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কথা শেষ হওয়ার কয়েকমিনিট পরে দুইজনেই নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলাম ফোন থেকে৷ এবং কী আশ্চর্য! যে ব্র্যান্ডগুলি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সেই ব্র্যান্ডগুলির বিজ্ঞাপন একের পর এক পপ আপ করছে মোবাইলের স্ক্রিনে৷ ওই দিনই প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কামাল বুঝতে পেরেছিলাম৷ উপলব্ধি হলো, দেওয়ালের কান থাকুক বা না-ই থাকুক-- ঘরে রাখা সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সত্যি সত্যি অদৃশ্য কান আছে৷
বছর তিনেক আগে কেবলমাত্র বিজ্ঞাপনের পপ আপ দেখেই আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম৷ ইদানীং বন্ধ ফোনের পাশে বসে কোনো বন্ধুর কথা আলোচনা করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ফ্রেন্ড সাজেশন চলে আসে৷ তার কোনো পোস্ট চলে আসে সবার উপর৷ কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে আলোচনা করলে তার পেজের সাজেশন চলে আসে৷ তার কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সেই বিজ্ঞাপন চলে আসে স্ক্রিনের ডগায়৷
তিনবছর আগে মধ্যবিত্তের শোয়ার ঘরে অ্যালেক্সা ছিল না৷ এখন ঘরে ঘরে৷ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ-- অ্যালেক্সা পারে না, এমন কিছু নেই৷ ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে অ্যালেক্সা৷ ঘুম পাড়াচ্ছে, ঘুম থেকে তুলছে৷ গান বাজাচ্ছে, ওষুধ খাওয়ার সময় বলে দিচ্ছে৷ অন্যদিকে ম্য়াকের সিরি মন খারাপ বললে মনোবিদের নম্বর জোগাড় করে দেয়৷ গল্প শোনায়৷ ভালো থাকার টিপস দেয়৷
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ভারত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করেন এক পরিচিত বিজ্ঞানী৷ তিনি বলছিলেন, গত এক দশকে ভারতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বহু কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে৷ ব্যক্তিগত ডেটা সরকারের খাতায় পৌঁছে যাচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে৷ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে গোপন কূটনৈতিক তথ্য আহরণে৷ ওই বিজ্ঞানীর ধারণা, সত্যি সত্যিই যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তা দাঁড়িয়ে থাকবে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের কূটনীতির উপরে৷
এ তো গেল ভবিষ্যতের গল্প৷ ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজকে কীভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গিলে ফেলছে, তার কিছু হাতেকলম তথ্য দেওয়া যাক৷ কনটেন্ট রাইটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত এক যুবক সম্প্রতি একটি অ্যাপ দেখালো৷ অ্যাপটি বেশ ভালো দামেই তাকে কিনতে হয়েছে৷ অ্যাপকে সে বলে দিচ্ছে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে ৫০০ শব্দ লিখে দিতে হবে৷ মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে যাচ্ছে লেখা৷ নিজেকে মাথা খাটিয়ে পড়তে হচ্ছে না, লিখতে হচ্ছে না৷ অ্যাপই সেই কাজ করে দিচ্ছে৷ কনটেন্ট রাইটিংয়ে এই অ্যাপ ইদানীং অনেকেই ব্যবহার করছে বলে জানালো ছেলেটি৷ অন্যদিকে, কলকাতার হাসপাতালে চলে এসেছে রোবট নার্স৷ রোগীর মাথায় হাত বুলিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছে সেই রোবট৷ গোটাটাই চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে৷
আশ্চর্য এই সব ম্যাজিক দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি হীরক রাজার দেশের কথা৷ সেই যন্ত্রমন্তর ঘর৷ সেখানে ঢোকানো আছে শ্রমিকের মন্ত্র, কৃষকের মন্ত্র, শিক্ষকের মন্ত্র৷ সে-ও তো আসলে এক ধরনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স৷ যন্তরমন্তরে ঢুকলেই মাথার ভিতর গেঁথে যাবে মন্ত্র৷
যে ছেলেটি অ্যাপের মাধ্যমে কনটেন্ট লিখে ফেলছে, তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে তো নিজের আর কোনো কাজই থাকলো না! পড়তেও হবে না, লিখতেও হবে না৷ অ্যাপকে বলে দিলেই হলো৷ যুবকের উত্তর-- পয়সা দিয়ে অ্যাপ তো কিনতে হয়েছে! তাকে তো বলতে হচ্ছে কোন বিষয়ে লিখতে হবে, কতটা লিখতে হবে৷ কোন কোন পয়েন্ট রাখতে হবে! তা-ই বা কম কী!
গত শতকের শেষের দিকে দেশে যখন প্রথম কম্পিউটার ঢুকলো, বিরাট আন্দোলনে নেমেছিল বাম দলগুলি৷ তাদের বক্তব্য ছিল, কম্পিউটার মানুষের কাজ খেয়ে নেবে৷ বাস্তবে হয়েছেও তাই! কম্পিউটার আসার আগে যে কাজ চারজনে করতেন, কম্পিউটার তা একজনে নামিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু তাই বলে কি সকলে কাজ হারালেন? যুগের সঙ্গে যারা মানিয়ে নিতে পেরেছেন, তারা নতুন নতুন কাজে অংশ নিয়েছেন৷ বস্তুত, কাজ ফুরোয় না৷ প্রযুক্তি নতুন কাজের জন্মও দেয়৷ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের কাজ কমিয়ে দেবে বলে যারা আজ হায় হায় করছেন, তারা তিন দশক আগের ইতিহাস আরেকবার ঝালিয়ে নিতে পারেন৷
কিন্তু এর চেয়েও বড় প্রশ্ন আছে৷ এক বিশিষ্ট মনোবিদ সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় এই প্রশ্নটিকে নানা দিক থেকে দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করেছেন৷ তার বক্তব্য, মানুষ পৃথিবীতে টিকে আছে তার বুদ্ধির জন্য৷ এই বুদ্ধির সাহায্যেই মানুষের সভ্যতা একের পর এক মাইলস্টোন পার করেছে৷ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও মানুষের সৃষ্টি৷ এ-ও এক বিরাট মাইল ফলক৷ কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে শেষপর্যন্ত প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা হেরে যাবে না তো! সাই ফাই ফিল্মে তেমন ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে৷ তৃতীয় বা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ আসলে মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধির হবে না তো?
প্রশ্ন কঠিন৷ উত্তর অজানা৷