গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি
২৯ অক্টোবর ২০২০পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-তে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আগুন দীর্ঘদিন ধরেই ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। হঠাতই তা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। একেবারে প্রকাশ্যে চলে এসেছে সভাপতি দিলীপ ঘোষ বনাম কৈলাস বিজয়বর্গীয়-মুকুল রায়দের লড়াই। এই লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূলত তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যোগ দেয়া নেতাদের সঙ্গে দলের পুরনো কিছু নেতার। একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূল থেকে আসা যুব বিজেপি সভাপতি ও মুকুল-ঘনিষ্ঠ সাংসদ সৌমিত্র খানের সব কমিটি ভেঙে দেন দিলীপ ঘোষ। তারপর না কি রেগে গিয়ে সৌমিত্র খান পদ ছড়ার কথা ঘোষণা করেন। পরে আবার সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করেন। ইতিমধ্যে দুই গোষ্ঠী একে অপরের উদ্দেশে সমালোচনায় সোচ্চার হয়। কলকাতা থেকে জেলা পর্যন্ত চলে এই ঝগড়া।
অবস্থা এমন জায়গায় চলে যায় যে, বাংলার কর্মীদের উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ ছেড়ে দিয়ে মিডিয়া পড়ে থাকে বিজেপি-র অন্দরের ঝগড়া নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তা মোদীর পছন্দ হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে এ বার ব্যবস্থা নেন মোদী-শাহ। দুই শিবিরকে সতর্ক করে দেয়া ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গেদলের সংগঠন সচিবকে বদল করা হয়েছে। দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে সরিয়ে অমিতাভ চক্রবর্তীকে নতুন সংগঠন সচিব করা হয়েছে। বিজেপি-তে সংগঠন সচিবের গুরুত্ব খুবই বেশি। সচরাচর আরএসএসের প্রচারকই এই পদে বসেন। বিজেপি হলো সংগঠনভিত্তিক দল। আর সংগঠনের চাবিকঠি থাকে সংগঠন সচিবের কাছে। এই পদে তাঁর ঘনিষ্ঠকে সরিয়ে দেয়া মানে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা দিলীপের বড় ধাক্কা।
অন্যদিকে কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে নিয়েও নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, তাঁকে মধ্যপ্রদেশে দলের কাজে বেশি নজর দিতে বলা হয়েছে। যদিও বিজেপির অন্য সূত্র এ কথা অস্বীকার করছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে কৈলাসকে কিছু জানানো হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নেতা শিবপ্রকাশের দায়িত্ব বাড়বে বলেই খবর।
এতে করে কি তিক্ততা ও বিরোধ কমবে বা শেষ হবে? না কি তা আবার ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকবে? ঘটনা হলো পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই ধরনের ঝামেলা দেখতে মানুষ অভ্যস্ত। কংগ্রেস ও তৃণমূল এই গোষ্ঠীবাজির জন্য বিখ্যাত। গোষ্ঠীবিরোধের জেরে একসময় প্রণববাবুর ধুতি ধরে পর্যন্ত টানাটানি করেছিল বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কংগ্রেসিরা। এখন দেখা যাচ্ছে, বিজেপি-র অন্দরে সেই কংগ্রেসি সংস্কৃতি জাঁকিয়ে বসেছে।
ক্ষতি কতটা হবে
ভোটের মুখে গোষ্ঠীবাজির এই চেহারা বেরিয়ে পড়ায় বিজেপি-র ক্ষতি কতটা হবে? ভোটদাতারা কি বিজেপির অন্দরের এই ছবি দেখে অন্তত মানসিকভাবে ধাক্কা খাবেন? তার প্রভাব কি ইভিএমে পড়বে?
বিজেপি-র তরফে এই গোলমালের ঘটনা বা তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যুব বিজেপি-র জাতীয় সম্পাদক সৌরভ শিকদার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''একটা রাজনৈতিক দলে পদাধিকারী বদল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেটাই হয়েছে। সংগঠনে পরিবর্তন নিয়ে এই হইচই ও রাজনীতি করার চেষ্টা অর্থহীন। এতে ভোটে প্রভাব পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।''
কিন্তু ঘটনা নিছক পরিবর্তন বলে দেখতে রাজি নন প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র। ডয়চে ভেলেকে শুভাশিস জানিয়েছেন, ''বিজেপি বহুদিন ধরে দাবি করে তারা হলো পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স, মানে অন্য ধরনের দল। কিন্তু যেভাবে তারা চলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তারা পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স নয়। যেভাবে তারা দল ভাঙিয়ে সরকার গঠন করে অথবা যে ধরনের ঝগড়া দেখা যাচ্ছে, তাতে আর যাই হোক, তারা ব্যতিক্রমী দল নয়।'' তাঁর মতে, যেভাবে অন্য দল থেকে লোক নেয়া হয়েছে, যেভাবে দলকে বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে, এ তারই ফল। একসময় তৃণমূলেও হয়েছে। নব্য বনাম আদিদের তুমুল ঝগড়া হয়েছে। এখন বিজেপি-তেও তাই হচ্ছে। এতে মানুষজন মানসিকভাবে ধাক্কা তো খানই।
দিল্লিতে দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি-কে কাছ থেকে দেখেছেন সাংবাদিক শরদ গুপ্তা। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এর আগে উত্তর প্রদেশ, বিহার, দিল্লি, রাজস্থান সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি-র অন্দরের ঝগড়া সামনে এসেছে। প্রতিবারই অমিত শাহ অত্যন্ত কড়াভাবে তা সামলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সেই একই ছবি দেখা যাচ্ছে। তবে যেহেতু অধিকাংশ দলেই এটা হয়ে থাকে, তাই ধাক্কাটা খুব বেশি হবে না। আর মোদী-শাহ কখনোই ঝগড়াটা হাতের বাইরে যেতে দেন না।''
ভোটে কতটা প্রভাব পড়বে
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আরো ছয় মাস বাকি। তার মধ্যে বিজেপি-র অন্দরে আমরা-ওরার লড়াই শুরু হয়েছে। শুভাশিস মনে করেন, ''এর খুব বেশি প্রভাব ভোটে পড়ার কথা নয়। কারণ, লোকে এই ঝগড়া দেখতে অভ্যস্ত। স্থানীয়ভাবে কিছুটা প্রভাব পড়ে ঠিকই। কিন্তু ইতিহাস বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকেও ঝগড়ার জন্য জেলা নেতৃত্বকে বদল করতে হয়েছে। বারবার বলতে হয়েছে, ঝগড়া থামান। না হলে ব্যবস্থা নেব। তারপরেও ভোট পেতে তাঁর অসুবিধা হয়নি।''
শরদের মতও একই। তবে তাঁর মতে, ''বিজেপি হলো সংগঠন-নির্ভর দল। তাই বিজেপি থেকে বাইরে গিয়ে কেউ সফল হতে পারেননি। অনেকে বেরিয়েছেন। কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, শঙ্করসিন বাগেলা, সদ্যপ্রয়াত কেশুভাই প্যাটেলের মতো অনেক নেতা-নেত্রীই আলাদা দল করেছেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। তাঁদের ফিরতে হয়েছে বিজেপি-তেই। ফলে বিজেপি-তে এই বিরোধ একটা মাত্রা পর্যন্ত থাকে।''
এটা ঠিক, দলের ভিতরে থেকে বিজেপি নেতারা অন্তর্ঘাত করার সাহস খুব একটা পান না। মোদী-শাহের আমলে কড়াহাতে দল চালানো হয়। এই ধরনের কাজ কখনোই বরদাস্ত করা হয় না। তাই ঝগড়া থাকবে। দিলীপ বনাম মুকুল, রাহুল সিনহা বনাম দিলীপের মতো আরো কিছু নেতা ও তাঁদের গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই ভবিষ্যতেও হতে পারে। তবে তা সম্ভবত মাত্রাছাড়া জায়গায় পৌঁছবে না।
তবে এর ফলে রাজ্যের মানুষ একটা কথা বুঝতে পারবেন, মতাদর্শের দিক থেকে কংগ্রেস, তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি-র প্রচুর ফারাক থাকতে পারে, কিন্তু গোষ্ঠী-লড়াইয়ের নিরিখে এই দলগুলির মধ্যে তফাৎ বিশেষ নেই।