ঘরের মধ্যেই গ্যাস চেম্বার
১ নভেম্বর ২০১৬শাহিদা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রান্নার সময় প্রচুর ধোঁয়া হয়, যাতে চোখে-মুখে ভীষণ জ্বালা করে৷ আমি তো এই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্টের রোগীতে পরিণত হয়েছি৷ এমনকি আমার সন্তানরাও শ্বাসকষ্টে ভুগছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমি বুঝতে পারছি রান্নার ধোঁয়ার কারণেই এটা হচ্ছে৷ কিন্তু এছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই৷''
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার চিত্রই এমন৷ এখনও শতকরা ৮৯ শতাংশ বাড়িতে রান্নার জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও গবাদিপশুর গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়৷ এছাড়া কয়লার ব্যবহারও আছে৷ এর বাইরে গ্যাস বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শতকরা ১০ ভাগের মতো পরিবার৷
আশুলিয়া এলাকা আরো কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের স্বাস্থ্য-চিত্রের তথ্য পাওয়া গেল৷ জানা গেল, স্থানীয় মানুষরা জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করেন৷ কেউ কেনেন, কেউ আবার সংগ্রহ করেন৷ গরুর গোবর সংগ্রহ করে কেউ কেউ আবার নিজেরাই শুকিয়ে রাখেন বা ঘুষি বানিয়ে নেন৷ এ জিনিস অবশ্য বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়৷ স্থানীয়রা জানান, এর বাইরে কাঠের গুড়া এবং ধানের তুষ রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ তবে তুষ এবং কাঠের গুড়ায় ধোঁয়া হয় সবচেয়ে বেশি৷
ওদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে যে, বাড়িতে রান্নার কাজে চুলায় কাঠ বা গোবর পোড়ানোর কারণে ঘরে যে বায়ুদূষণের সৃষ্টি হয়, তাতে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে আট হাজার শিশুর মৃত্যু হয়৷
‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার অফ চিলড্রেন: দ্য ইমপ্যাক্ট অফ এয়ার পলিউশন অন চিলড্রেন' শীর্ষক ইউনিসেফ-এর ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি খুবই বেশি৷ দেশে উন্নত রান্নার চুলা ব্যবহার তুলনামূলকভাবে সীমিত হওয়ায় কাঠ বা গোবর পোড়ানো চুলা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে৷
কয়লা, কাঠ, গোবর ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া ও তাপে ঘরের বায়ু দূষিত হয়৷ বলা বাহুল্য, গ্রামাঞ্চলের স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুরাই এর সবচেয়ে বড় শিকার৷ রান্না ছাড়াও শীতে ঘর গরম করার জন্যও এ সব ব্যবহার করা হয় বলে জানায় প্রতিবেদনটি৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘরে বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকার কারণ হলো তারা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়৷ এছাড়া শিশুদের ফুসফুসের কোষের স্তর দূষিত কণায় অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ পাশাপাশি দ্রুত দূষিত কণা মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের ঝিল্লি ভেদ করে৷ এতে শিশুর বুদ্ধির বিকাশে স্থায়ী ক্ষতিসাধিত হয়৷ এমনকি দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভ্রূণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কাঠ, গোবর, কাঠের গুড়া বা তুষ পুড়ে কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি করে, যা শিশুদের জন্য ভয়াবহ৷ এর প্রভাবে শিশুদের রক্তের চাপ তাৎক্ষণিকভাবে ওঠা-নামা করে৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যাওয়া শিশুরা যেন বিষাক্ত গ্যাসের কুণ্ডলির মধ্যে পড়ে যায়৷ ফলে সাফোকেশন হয়৷ কমে যায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, বাড়ে শ্বাসকষ্ট৷ তখন তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়৷ বসতঘরের সঙ্গেই রান্না ঘর থাকায় এই বিষাক্ত গ্যাস থেকে নারী বা শিশু – কেউই রেহাই পায় না৷ কারণ নারীরা রান্না করেন আর শিশুরা বাড়িতে থাকে৷''
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলকে বলেন, ‘‘তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসকষ্ট ছাড়াও রান্নার এই ধোঁয়ার কারণে শিশুর স্থায়ী ক্ষতি হয়৷ তারা অ্যাজমা রোগীতে পরিণত হয়৷ এই ধোঁয়ার নেতিবাচক প্রভাব মস্তিষ্কেও পড়ে৷ বাধাগ্রস্ত হয় স্বাভাবিক বৃদ্ধি৷ এমনকি এতে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে৷''
দু'জনই বলেন, এ অবস্থার প্রাথমিক সমাধান হলো রান্নাঘর বসতঘর থেকে অনেক দূরে রাখা৷ তবে তাতে শিশুরা রেহাই পেলেও নারীরা রেহাই পান না৷ তাই প্রয়োজন বিকল্প জ্বালানি এবং আধুনিক পরিবেশ-বান্ধব চুলা৷
ইউনিসেফ-এর কথায়, এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে বাংলাদেশে উন্নত ও পরিষ্কার চুলা ব্যবহার করতে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷ একমাত্র সেটা করা সম্ভব হলেই ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে৷
এই লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে তিন কোটিরও বেশি পরিবারকে উন্নত চুলা ও রান্নার সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে৷ আর তা হলে অন্তত শিশুদের ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত রাখা যাবে৷
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে ইউনিসেফ-এর ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি সাতজন শিশুর একজন এমন এলাকায় বসবাস করে, যেখানকার বাতাস ভয়াবহ পরিমাণে দূষিত৷ আর এই বায়ুদূষণের শিকার শিশুদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ার৷
প্রসঙ্গত, বিশ্বে বায়ুদূষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ৩০ কোটি৷
আপনারও কি অনুরূপ অভিজ্ঞতা আছে? জানান আমাদের, লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷