চকবাজারে আগুনে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯বুধবার রাতে চকবাজারের যে রাজ্জাক ভবনে প্রথমে আগুন লাগে সেখানে রাসায়নিকের গুদাম ছিল৷ আন্ডারগ্রাউন্ড এবং একতলা ও দোতলায় ছিল সুগন্ধি কেমিক্যালের গুদাম৷ আর নীচ তলায় প্লাস্টিকের কাঁচামালের দোকানও ছিল৷ সরু গলির ভিতরে ওই ভবনে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন লাগার সময় গলিটি ছিল যানজটে পরিপূর্ণ৷ এরপর আগুন আরো ৪-৫টি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে৷ সরু গলির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঠিকমত ঢুকতে পারেনি, পানি পাওয়া যায়নি৷ তাই ঢাকার ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ ইউনিট একযোগে কাজ করলেও আগুন থেকে রক্ষা করা যায়নি মানুষের জীবন আর সম্পদ৷
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বৃহস্পতিবার সকালে ৭০টি মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আগুন নিয়ন্ত্রণে, তবে পুরোপুরি নেভেনি৷ কিছু কিছু জায়গায় এখনও আগুন জ্বলছে৷ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান, বডি-স্প্রে, প্লাস্টিক দ্রব্য এসবের কারণে আগুন ছড়িয়েছে৷ আর সরু রাস্তার কারণে আগুন নেভানোর কাজে সমস্যা হয়েছে৷ লাশের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা আছে৷’’
পুরান ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টা আর নিমতলী এলাকা যেমন ঘিঞ্জি আর সরু গলির, তেমনি সেখানে রয়েছে নানাধরণের রাসায়নিকের গুদাম, কসমেটিকস ও প্লাস্টিকের কারখানা৷ ফলে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস যেমন ঠিকমত কাজ করতে পারেনা তেমনি কেমিক্যালের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷
৮ বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন এই পুরান ঢাকারই নিমতলীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আগুন লেগে ১২৪ জন নিহত হন৷ কেমিক্যাল গুদামের কারণেই ওই আগুনে পুরো এলাকা পুড়ে হয়ে যায়৷ ওই আগুনের পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম, কারাখানা সরিয়ে নেয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু ৮ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি৷
সেসময়ে নিমতলীর উদ্ধার অভিযানে ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের তখনকার উপ-পরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভূইয়া৷ তিনি এখন অবসরে গেছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নিমতলীর ঘটনার ৮ বছর পর চকবাজারের ঘটনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই৷ কেমিক্যাল গুদাম আর কসমেটিকস কারখানার দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷ আর পুরান ঢাকার পথ ঘাট সরু হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারেনা৷ ফায়ার ফাইটাররা ঠিকমত কাজ করতে পারেনা৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এরকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোনো দাহ্য পদার্থের কারখানা থাকতে পারেনা৷ এসব কারখানার কেমিক্যালের ড্রামের ওপরই থাকে আবার বিদ্যুৎ সংযোগ৷ নিরাপত্তা বলে কিছু নেই৷ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি৷ আমরা নিমতলীর ঘটনার পর ৮০০ কেমিক্যাল কারখানা চিহ্নিত করে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেছিলাম৷ কিন্তু পরে আর তা সরানো হয়নি৷ সরকার বলেছিল পর্যায়ক্রমে সরাবে৷ কিন্তু হয়নি৷ আমরাতো প্রতিবেদন দিয়েছি৷ আমাদের ওপরে অনেক বড় কর্তারা আছেন৷ তারাই বলতে পারবেন কেন সরানো হয়নি৷’’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই কেমিক্যাল কারখানাগুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরানোর কথা৷ নানা জটিলতার কারণে এতদিনেও সরানো যায়নি৷ এরজন্য কেরানীগঞ্জ বা মুন্সিগঞ্জে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে৷ জমি অধিগ্রহণের কাজ এত সহজ নয়৷ তারপরও গত সপ্তাহে আমরা শিল্প মন্ত্রণালয় ও এফবিসিসিআই'র সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ওই কেমিক্যাল কারখানাগুলোর কোনো বৈধতা নেই৷ আমরা কোনো লাইসেন্সও দেইনা৷ আর ওখানকার বাড়ির মালিকরা কেমিক্যাল কারখানার জন্য ভাড়া দিলে বেশি ভাড়া পায়৷ সেই লোভেই পুরনো ঢাকায় কেমিক্যাল কারখানা কমছেনা, বরং বাড়ছে৷ চকবাজারে যে বাড়িতে আগুন লেগেছে, তিনি নিজে ওই বাড়িতে থাকেন না৷ তিনি অন্যত্র থেকে বেশি ভাড়ায় কেমিক্যাল গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন৷’’
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের আইজি জাবেদ পাটোয়ারী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরনের আবাসিক এলাকা, জনবহুল এলাকার মধ্যে কেমিক্যাল গোডাউন থাকা উচিত না৷ এখনই সময় এগুলো সরিয়ে নেওয়ার৷’’ পুলিশ এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলোর ক্ষেত্রে অনেকগুলো পক্ষ কাজ করে৷ পুলিশ তো অবশ্যই ভূমিকা রাখবে, কাজ করবে৷ তবে তার আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং সরকারের যে অন্যান্য দপ্তর আছে, যারা এগুলো মনিটর করে, তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরানোর৷ এগুলো সরানোর কাজ এখনই শুরু করা উচিত৷
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চকবজারে আগুনে নিহত ও আহতদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, ‘‘নিহতদের পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে এবং আগুনে আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন৷ দায়িত্বপ্রাপ্তদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা এবং সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি৷’’