1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

একটা পয়সা দেবে?

দেবারতি গুহ২ আগস্ট ২০১৫

ট্র্যাফিক সিগনালে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িটা৷ তার মধ্যেই আপনার দিকে ছুটে এলো কয়েকটা শিশু৷ কারুর হাতে ফুল, কারুর বা মরসুমি ফল অথবা সিনেমার পত্রিকা৷ তবে কারু কারু হাতে কিছু নেই৷ মুখে শুধু প্রশ্ন – একটা পয়সা দেবে?

https://p.dw.com/p/1G7p3
Kinderarbeit in Kambodscha
ছবি: picture-alliance/dpa

ওরা শিশু ভিখারি৷ ঢাকা-কলকাতাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু শহর এবং শহরতলির রাস্তাঘাটে, লোকাল ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে, হাসপাতালের সামনে, ফুটপাথে দেখে মেলে এদের৷ পরনে ছেঁড়া জামা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খালি পা, ধুলো-মাখা শরীর – কখনও সুস্থ, কখনও আবার বিকলাঙ্গ৷

মনে পড়ে নতুন দিল্লিতে পড়াশোনা করার সময়, প্রতিদিনই একটা ফ্লাইওভারের নীচে কয়েকটা বাচ্চাকে দেখতাম৷ দিনের পর দিন একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার জন্য ওদের সঙ্গে আমার একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল৷ তাই এক টাকায় একটা গোলাপের জায়গায় কখনও কখনও দুটো গোলাপও আমার হাতে গুঁজে দিত ওরা৷ আর আমিও কোনোদিন পাউরুটি, কোনোদিন চকলেট ধরিয়ে দিতাম তাদের৷ এভাবে বন্ধুতাও বাড়ছিল৷

একবার কী হয়েছে, দিল্লিতে ভীষণ শীত পড়লো৷ কনকনে ঠান্ডা, দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা পড়ে৷ তাই ভাবলাম ওদের জন্য গরম জামা, সোয়েটার আর প্রত্যেককে একটা করে জুতো কিনে দেবো৷ তখন আমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা খবরের কাগজে পার্টটাইম কাজ করি৷ তাতে যা রোজগার ছিল, সেটা জমিয়েই দিলাম সবাইকে সাধ্যমতো৷ ওরা তো ভীষণ খুশি – এটা আমার, এটা আমার করে নিমেষের মধ্যে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিল ওরা৷ ভাবলাম, বাহ্ কাল থেকে ওদের আর খালি পায়ে ভিক্ষে করতে হবে না৷

কিন্তু কোথায় কী! সকালে বের হয়ে দেখি, ওরা ঠিক আগের মতোই খালি পায়ে ফ্লাইওভারের তলায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ঠান্ডা লেগে সবচেয়ে ছোট, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতো যে মেয়েটা – তার কাশি হয়ে গেছে৷ তারপরেও গায়ে একটা ময়লা সুতির জামা ছাড়া কিচ্ছু নেই! আমি দূর থেকেই চেঁচিয়ে বললাম – এই, তোদের জামা-জুতোগুলো গেল কই? কেউ কি কেড়ে নিয়েছে, বকা দিয়েছে তোদের? ওরা কোনো উত্তর দিল না, উলটে দৌড়ে পালিয়ে গেল৷ হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে...৷

এর কয়েক সপ্তাহ পর আমি জার্মানি চলে আসি৷ কিন্তু আজও দিল্লিতে গেলে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ঐ ফ্লাইওভারটা দেখলে আমার ওদের কথা মনে পড়ে৷ মনে হয় আমার জন্যই হয়ত ওরা হারিয়ে গিয়েছিল সে'দিন৷ জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে ওরা....কত বড় হয়েছে? কী করছে?

জার্মানির রাস্তায় বাচ্চা ভিক্ষুকদের নিষিদ্ধ করেছে সরকার৷ অথচ আমাদের দেশে শিশুশ্রম-বিরোধী আইন থাকলেও, এই সহায়সম্বলহীন শিশুদের জন্য কারো মাথাব্যথা নেই৷ তাই হাত-পা কেটে বিকলাঙ্গ করে ওদের দিয়ে ভিক্ষা করাতে কারুর এতটুকুও আটকায় না৷ শিশুকন্যাদের ধর্ষণ করে তাদের পতিতাবৃত্তিতে নামায় যে চক্র, তেমনই সব নারকীয় চক্র রয়েছে বাচ্চাদের ভিখারি বানানোর জন্য৷

এই যেমন, ঢাকার মান্ডায় পানির পাম্প এলাকায় এমনই একটা ভিক্ষুক বানানোর কারখানা ছিল৷ সেখানে বস্তি, বাস বা রেল স্টেশন – এমন নানা জায়গা থেকে পথহারাদের ধরে আনার কাজ করতো একটা চক্র৷ অঙ্গহীন শিশুদের দেখে মানুষের মনে যে দয়ার উদ্রেক হয়, সেটাই যে এই ব্যবসার মূল চাবিকাঠি! সে কারণে নির্দয়ভাবে সুস্থ একটি শিশুকে বিকলাঙ্গ করতে তাদের দ্বিধাবোধ থাকবে কেন? তাই যে শিশুরা কলকারখানা, রেস্তোরাঁ, মোটর গ্যারেজ, চা বাগান, ট্যানারি, প্লাস্টিক কারখানা, কৃষি অথবা বাড়ি বাড়ি কাজ করে, তাদের থেকে শিশু ভিখারিদের অবস্থা আরো শোচনীয়৷

আমার তো মনে হয়, অসাধু এ সমস্ত চক্রের সঙ্গে প্রশাসনেরও হাত ছিল, আছে৷ তা না হলে মহিলাদের ধরে ‘মা' বানিয়ে তাদের হাতে এক-একটা বিকলাঙ্গ শিশু ধরিয়ে দেয়ার কাজটা কি এতই সহজ?

বাংলাদেশের আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে সহায়তাকারী বা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত অপরাধে অন্ততপক্ষে তিন বছরের কারাবাসের বিধান রয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ধরনের অপরাধ চক্র দমনে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু তারপরেও কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ আজও এ দেশে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ ভিক্ষাজীবী আছে, গড়ে যাদের দৈনিক রোজগার ১০০ থেকে ২০০ টাকা৷ অর্থাৎ এখনও বাংলাদেশে চলছে ভিক্ষা-বাণিজ্য৷

Deutsche Welle Süd-Ost-Asien Debarati Guha
দেবারতি গুহ, ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের সম্পাদকছবি: DW

মানবাধিকার, শিশু আইন – এ সব তো আমাদের জন্য বড় বড় কথা৷ যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়', সেখানে টাকার বিনিময়ে এতিম শিশু আর বৃদ্ধদের কিনে শারীরিকভাবে অক্ষম করে ভিক্ষার কাজে লাগানো হলে – অবাক হওয়ার কী আছে? তার ওপর বাচ্চাটি ছোট্ট এবং মিষ্টি হলে তো কথাই নেই – কারণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা কোনো কথা না বললেও, একটা টাকা নিশ্চয়ই গুঁজে দেবো৷ আর শিশুটিও নাচতে নাচতে তার ‘মালিক' বা ‘সর্দার'-এর কাছে চলে যাবে৷

কথায় বলে না – ‘বেগার্স কান্ট বি চুজার্স? – মানে ভিখারির কোনো বাছ-বিচার থাকতে নেই? আমাদের দেশে এ সব অসহায় মানুষগুলোরই হয়েছে সেই দশা৷ তবে কোনো জিনিস নয়, নিজের পছন্দসই জীবন বেছে নেয়ার, এমনকি সুস্থভাবে বাঁচারও কোনো অধিকার নেই এদের৷ এরা ভিক্ষুক, এরা ব্রাত্য, এরাই আমাদের অতি পরিচিত ‘টোকাইয়ের' দল!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য