‘ছেলে-মেয়েরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে’
৯ আগস্ট ২০১৮সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে তাদের এই ‘চাপটার' দরকার ছিল৷ আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলছেন, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন পরিবহন খাতে অনিয়মের বিষয়ে তাদের ‘চোখ খুলে দিয়েছে'৷
এই আন্দোলনের মূল বক্তব্যকে সামনে রেখে সড়কে মৃত্যু রোধে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা৷
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে৷
ঢাকার কারওয়ানবাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে কলেজছাত্র রাজীবের হাত এবং মহাখালীতে বাসচাপায় গৃহকর্মী রোজিনার পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার মৃত্যু নিয়ে অসন্তোষের রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানি হয়৷
এরপর নিরাপদ সড়ক দাবিতে বিক্ষোভে নামে স্কুল ছাত্রছাত্রীরা৷ ঢাকা থেকে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে৷ সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন আসে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনের ঢেউ৷
নয় দফা দাবিতে এই আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীরা সড়কে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করা শুরু করে৷ নির্ধারিত লেইন ধরে যেতে রিকশা চালকদের বাধ্য করেন তারা, যার ছবি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়৷ টানা ১০ দিনের মতো আন্দোলন শেষে ক্লাসে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা৷
এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের ইকোরিয়ায় বিআরটিএ-এর পরিবহন তদারকি কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের৷ ক্ষোভ থেকেই শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
ওবায়দুল কাদেরকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে এখন যেভাবে সচেতনতা গ্রো করেছে, এটাও কিন্তু ভয়ভীতির কারণ হয়েছে৷ মাঝে মাঝে এ ধরনের চাপ না এলে আসলে আমাদের সচেতনতা আসে না৷ এই চাপটার বড় প্রয়োজন ছিল৷''
ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত রোববার থেকে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করুন; ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতির সভ্যতার প্রতীক' স্লোগান নিয়ে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করছে পুলিশ৷ আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ বিভিন্ন স্থানে সড়কের অনিয়ম রুখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে৷
দুর্ঘটনা কমাতে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘এটা সবার উপলব্ধি করা উচিত… আমরা এখন থেকে সচেতন না হলে, আমরা যদি ইমপ্লিমেন্টেনশন প্রসেসে না যাই এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটাকে তরাণ্বিত না করি, তাহলে আরও ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে৷''
পরিস্থিতি উত্তরণের এখনই সময় বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম৷
দুপুরে তোপখানা রোডে জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ে এক বৈঠক শেষে তিনি বলেন, নিরাপদ সড়ক আইনের বাস্তবায়ন চান তারা৷
কোনো লাইসেন্সবিহীন গাড়ি যেন দেশের কোথাও চলতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা অনেক শৈথিল্য দেখিয়েছেন, আপনারা অনেক অনিয়ম করেছেন৷ এখন সময় এসে গেছে, কিশোররা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে৷''
মন্ত্রী, এমপি যে-ই হোক কেউ যাতে লাইসেন্সবিহীন চালক এবং ফিটেনসবিহীন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় চলতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান নাসিম৷
‘‘আপনারা কোনো খাতির কাউকে করবেন না৷ এটা আমি হলেও করবেন না, অন্য কেউ হলেও করবেন না৷''
‘‘আমি সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বলছি, আমিও যদি কোনো আইন লংঘন করি, এজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে৷ ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷ নিয়ম মানতে হলে কঠোর হতে হবে৷ কঠোর ছাড়া নিয়ম বাস্তবায়ন সম্ভব না৷''
মন্ত্রীরা একথা বললেও এক্ষেত্রে সরকার কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে৷ গত ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক হারে প্রাণহানির মধ্যে মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় ওঠে৷
ওই বৈঠকে চালকদের দিনে একবেলার বেশি গাড়ি চালানো বন্ধসহ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেছে কি না সে বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি৷
ছাড় পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের নবম দিন সোমবার পুলিশের উপর হামলা ও ভাংচুরের দুই মামলায় গ্রেপ্তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীকে দু্ই দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে ঢাকার একটি আদালত৷
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সত্যব্রত শিকদার বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷
বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই শিক্ষার্থীদের ‘সাধারণ ক্ষমা' ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উপাচার্য৷
তাদের ওই আহ্বান নাকচ করে মন্ত্রী বলেছিলেন, যারা ‘অপরাধ করেছে' তাদের অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে৷
শহীদুলের ওপর নির্যাতনের অভিযাগ তদন্তের নির্দেশ
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা' প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে গোয়েন্দা হেফাজতে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে কি না- তা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছে হাই কোর্ট৷
বিষয়টি পরীক্ষা করে স্বরাষ্ট্র সচিবকে সোমবারের মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে৷
শহীদুলকে রিমান্ডে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং তাকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন জানিয়ে তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদের করা রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়৷
এই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার শহিদুল আলমকে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজত থেকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়৷ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে শহীদুলের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়৷
সে অনুযায়ী বুধবার সকালে শহীদুলকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হয় এবং চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে৷ বিকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে তাকে আবার গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়৷
শহীদুলকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি বলে ভাষ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের৷
এএইচ/এডিকে