জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও শোকগাথা
৩১ মার্চ ২০১৭কুমিল্লার কোটবাড়ীতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে তিন দিন ধরে ঘিরে রাখা একটি বাড়িতে শুরু হয়েছে সোয়াটের এই ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট'৷ শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে সোয়াট ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা কোটবাড়ীর দক্ষিণ বাগমারার ওই এলাকায় পৌঁছান৷ এরপর বেলা ১১টার পর দু'দফা গুলির শব্দ পাওয়া যায়৷ সোয়া ১১টার দিকে সৈকত নামের এক পুলিশ সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই এলাকা থেকে বের করে নিয়ে যেতে দেখা যায়৷
পুলিশ সুপার শাহ মো. আবিদ হোসেন জানিয়েছেন, জননিরাপত্তার স্বার্থে শুক্রবার সকাল থেকে কোটবাড়ীর দক্ষিণ বাগমারার ওই এলাকায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন৷ বন্ধ রাখা হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ৷ তিন তলা ওই বাড়িতে এক বা একাধিক জঙ্গি অবস্থান করছে এবং তাদের কাছে বিস্ফোরক রয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা৷
অন্যদিকে, মৌলভীবাজার শহরের বড়হাটে তিন দিন ধরে ঘিরে রাখা জঙ্গি আস্তানায় চলছে সোয়াটের ‘অপারেশন মেক্সিমাস'৷ ঐ আস্তানায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক থাকার কথা জানিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, এই অভিযান শেষ করতে সময় লাগতে পারে৷
ওদিকে, সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণে আহত র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মারা গেছেন৷ সিঙ্গাপুর থেকে ফিরিয়ে আনার পর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাঁকে৷
বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে চিকিৎসকরা আজাদকে মৃত ঘোষণা করেন বলে র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন৷ সিলেটে জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদের অভিযানের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যার পর কাছের এলাকায় বিস্ফোরণে আহত হন আজাদ৷ ওই বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ ছ'জন নিহত হন৷ র্যাব কর্মকর্তার মৃত্যুকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকে৷
মুনমুন শারমিন শামস ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘আমরা শোক প্রকাশ করতে পারি৷ প্রতিবাদীও হতে পারি৷ কিন্তু যার যায়, সেই পরিবারই জানে, সেই শোক, সেই ক্ষতি কতটা অপরিমেয়, কোনোদিন এই শূন্যতা ভরে না৷ জঙ্গিবাদ এভাবে কত কত পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে৷ ইশরাত আখন্দ থেকে কর্নেল আজাদ, আরো কত কত নাম৷ তবু আমাদের ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম আর মৌলবাদের ক্রীম যারা মাখার তারা তো মেখেই যাচ্ছেন৷''
লেখিকা তসলিমা নাসরিন লিখেছেন, ‘‘ব়্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জিহাদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন৷ মাথা নুইয়ে তাঁকে জানাচ্ছি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা৷''
সাংবাদিক আনামেশ আনাম লিখেছেন, ‘‘আশা করি, সব কিছুতে ‘নাটক' খুঁজে পাওয়া সম্প্রদায় এই মানুষটার সু-অভিনয়ের জন্য এবার মন খুলে হাততালি দিবেন৷ এ দেশে দু'রকমের বেঈমান আছে৷ একদল আপনাকে নিয়ে টক-শো করবে, অন্যদল মৃত্যুর পর আপনার কী কী নিন্দা করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বসবে৷ এদের মিল অবশ্য একটা জায়গায় আছে৷ দু'দিন পর দু'পক্ষই আপনাকে ভুলে যাবে৷ তবে গুটিকয়েক নিশ্চুপ বাস্তববাদীর স্মরণে আপনি বেঁচে থাকবেন সবসময়৷ বিদায়, আবুল কালাম আজাদ৷ ভালো থাকবেন৷''
বিকাশ দেবনাথ লিখেছেন, ‘‘তাঁরা ক্রিকেটার নন৷ ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ' হবার কপাল নিয়ে জন্মাননি তাঁরা৷ তবু সিলেটের ওই বাসায়, আটকে পড়া সেই পঙ্গু বাবাকে তাঁরাই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন৷ না, গ্যালারিতে বসে আমরা হাততালি দেইনি৷ দগ্ধ শরীরের বর্ণনাতীত কষ্ট নিয়ে তিনি তিলে তিলে মরে গেছেন৷ সিলেটের সেই বাসা থেকে যে ৭৮ জন বাসিন্দা নিরাপদে ফিরে এসেছেন, আজকের এই সকালে তাঁরা যে হাসছেন, কাঁদছেন, চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, কাদের প্রাণের বিনিময়ে? না ভাই, তাঁদের নাম আমি নিজেও জানি না৷ বাংলাদেশের কিছু মানুষ হত্যার খেলায় নেমেছেন৷ বিপরীতে, কিছু মানুষ নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছেন, অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে৷ সেইসব প্রকৃত ম্যান অফ দ্য ম্যাচ-এর শ্রদ্ধা৷''
বাহা উদ্দীন আকিফ লিখেছেন, ‘‘সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে আহত র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু৷ আফসোস! মাথায় শত প্রশ্ন! গভীর শ্রদ্ধা এই বীর সেনানীর প্রতি৷''
দীপরাজ ধর লিখেছেন, ‘‘যারা জন্মগতভাবে সব কিছুকে নাটক মনে করেন, তাদের মুখে ঝাঁটা মেড়ে সুমহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আত্ম উৎসর্গকারী এই বীরকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই৷''
আবু জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘‘চলে গেলেন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদ ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহী রাজিউন, সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে আহত র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা আজাদকে মৃত ঘোষণা করেন৷''
আব্দুল্লাহ আল শফি লিখেছেন, ‘‘দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ‘ক্রাইম-সিন ম্যানেজমেন্ট' একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ ঘটনাস্থলের কতটুকু জায়গা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হবে এবং মজমা-প্রেমী জনতাকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, সেসব নিয়ে কাজ করা জরুরি৷ তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যুর পরে র্যাবের গোয়েন্দা প্রধানের মৃত্যু আরেকটি বড় ক্ষতি৷ শোক জানাচ্ছি এই অপূরণীয় ক্ষতিতে৷ নিন্দা ও ধিক্কার জানাই কূচক্রিদের প্রতি!''
সংকলন: অমৃতা পারভেজ
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ