জঙ্গিরাই অভিজিতের হত্যাকারী: প্রতিবাদে উত্তাল ঢাবি
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে শুক্রবার সকাল থেকেই শুরু হয় অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে মিছিল- সমাবেশ৷ রাজু ভাস্কর্যের প্রতিটি প্রতিকৃতির চোখে বাঁধা হয় কালো কাপড়৷ ভাস্কর্যের সামনে ‘আক্রান্ত মুক্তচিন্তা' ব্যানারে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া, সাংবাদিক কামাল লোহানী, লেখক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রাণা দাশ গুপ্ত, মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, হামিদা হোসেনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতারা৷
সমাবেশে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘‘তাদের হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে সাধারণ মানুষও বলতে পারবে জঙ্গিগোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘অভিজিতকে যখন হত্যা করা হয়েছে তখন রাত গভীর হয়নি৷ টিএসসির সামান্য দূরে তাকে হত্যা করা হয়েছে৷ হুমায়ুন আজাদকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেভাবে রাজীব হায়দারকেও হত্যা করা হয়৷ একইভাবে অভিজিতকে হত্যা করা হলো৷''
অভিজিতকে হত্যার জন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দায়ী করে প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘একাত্তরের পরাজিত শক্তি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷ তারা বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী দেশ করতে চায়, বাংলাদেশকে ‘বাংলাস্তান' করতে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা চলতে পারে না৷ আমরা এটা চলতে দিতে পারি না৷ এদের প্রতিহত করতে আমাদের একই কাতারে দাঁড়াতে হবে৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে আজকের এই দিনে যখন হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হয়, তখনও ওই এলাকায় পুলিশ উপস্থিত ছিল৷ তাদের উপস্থিতিতে কী ভাবে একজনকে হত্যা করা হয়েছিল তা আমার প্রশ্ন৷''
সমাবেশে সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী শক্তির বিচার অসমাপ্ত রাখায় দেশে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে৷ পুলিশ দুই-তিন স্তরের নিরাপত্তার কথা বলে৷ কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা কোন স্তরে থাকে, তারা তা জানে না৷''
কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘‘দেশ প্রগতিশীল চিন্তার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে৷ এটা হতে দেয়া যাবে না৷''
মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেন বলেন, ‘‘অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলের অনেক কাছেই পুলিশ ছিল৷ এত কাছে থেকে তারা কী করছিল, সে প্রশ্ন আমাদের করতে হবে৷''
ব্লগার ও লেখক পারভেজ আলম বলেন, ‘এই পুলিশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের শাহবাগে দাঁড়াতে দেয়না না৷ ছবির হাট উঠিয়ে দেয়৷ নানা অভিযোগে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে৷ কিন্তু মুক্তচিন্তার ওপর হামলাকারী খুনিদের ধরতে পারে না৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরতে না পারলে এর দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে৷''
তাদের বক্তৃতার সময়, ‘আমার ভাই নিহত কেন, পুলিশ-ব়্যাব জবাব দে', ‘ক্যাম্পাসে লাশ কেন, প্রশাসন জবাব দে' প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকেন উপস্থিত সবাই৷
অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শাহবাগে অবস্থান নেন গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা৷ অভিজিৎ রায় হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত অবস্থান চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার৷
মামলা ও তদন্ত
অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন৷ মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে আসামি করা হয়নি৷
লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার দায় আনসার বাংলা-৭ নামের একটি সংগঠন স্বীকার করেছে৷ আর শাফিউর রহমান ফারাবী নামে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত এক যুবক তাকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল৷ সে ফেসবুকে বলেছে, ‘‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না, তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে৷'' শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর এই ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ পরে জামিনে ছাড়া পান তিনি৷
পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার এস এম শিবলী নোমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ব্লগার রাজীব, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর যেভাবে হামলা করা হয়েছিল, এবারের হামলাটাও একই ধরনের৷ আমরা সেই সূত্র ধরেই তদন্ত শুরু করেছি৷ আমরা মনে করছি একই গোষ্ঠী অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে৷''
শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা কাজ করছি, সময় ধরে বলা যাবে না৷ তবে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব এর পেছনে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে৷ এখনো কাউকে এই ঘটনায় আটক করা হয়নি৷''
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থল থেকে তারা রক্তমাখা দুটি চাপাতি ও কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছেন৷ দুটি চাপাতির হাতল কাগজে মোড়ান ছিল৷
জঙ্গিগোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে
অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে ডয়চে ভেলেসহ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী অভিজিতকে হত্যা করেছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘এরাই বাসে আগুন দেয়, পেট্রোলবোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে৷ হতভাগ্য পিতা হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আমি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি৷'' তাঁর কথা, ‘‘পুলিশের কাছে সব তথ্য রয়েছে৷ তাদের ধরতে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না৷ এ জন্য প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা৷''
তিনি বলেন, ‘‘অভিজিতকে দেশে আসতে মানা করেছিলাম৷ তাকে বলেছিলাম বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন তোমার জন্য সুখকর নয়৷ কিন্তু সে তার মাকে দেখতে এবং এবারের বইমেলায় তার দুটো বই প্রকাশিত হওয়ায় দেশে আসে৷''
অভিজিতকে হুমকি দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দেশে আসার পর যত দূর জেনেছি, হুমকি আসেনি৷ তবে দেশে আসার আগে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল৷''
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে অভিজিৎ রায়ের প্রতি আগামী রোববার শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে৷ ওই দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হবে৷ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর অভিজিৎ রায়ের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে গবেষণার জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে গুরুতর আহত করে৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর অভিজিৎ রায় মারা যান৷ রাফিদা আহমেদকে স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে৷ শুক্রবার ভোররাতে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল ল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়৷