জাপানের বিপর্যস্ত মানুষদের সহায়তায় চিত্রশিল্পী লাইকো ইকেমুরা
১২ এপ্রিল ২০১১শিল্পী ইকেমুরা ছবি বিক্রির অর্থ জাপানে পাঠাবেন
স্বদেশ জাপানের খবরাখবর দূর থেকে পেলেও দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে লাইকো ইকেমুরার মন৷ তাঁর ভাই বাস করেন টোকিওর কাছে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার নিরাশ্রয় মানুষগুলির সাহায্যের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন এখন এই শিল্পী৷ তাঁর আঁকা ছবি বিক্রির টাকা পাঠাতে চান তিনি এই সব মানুষের জন্য৷ বন শহরের কাছে ট্রোয়াসডর্ফে তাঁর আঁকা রেখাচিত্র ও ছবির বইএর একটি প্রদর্শনী চলছে এখন৷
২০০৭ সালে আঁকা ছবিটির নাম ‘তরঙ্গ'৷ একটি সাদা ফ্রক পরা মেয়ে বিশাল কালো জলোচ্ছ্বাসের ভয়াল থাবার হাত থেকে পালাচ্ছে৷ আকাশটাও ঘন কালো৷ জাপানের অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা শিল্পী কাটসুহিকা হোকুসাই-এর একটি কাঠ খোদাই করে আঁকা ছবি অবলম্বনে অঙ্কিত এই ছবিটি৷ আজকের জাপানের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায় দৃশ্যপট৷ মনে হয় যেন শিল্পী লাইকো আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন সুনামির এই ধ্বংসযজ্ঞ৷ ঊনষাট বছর বয়স্ক শিল্পী লাইকো প্রকৃতির এই শক্তিকে বিস্ময়ভরা চোখে দেখেছেন, করেছেন তাঁর শিল্পকর্মের মূল বিষয়৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা সাগরের খুব কাছাকাছি বসবাস করতাম৷ চারিদিকের দৃশ্যটা মনোরম হলেও মনের ভেতরে একটা ভীতি কাজ করতো সবসময়৷ মনে হত, যে কোনো সময় কিছু ঘটতে পারে৷ প্রাকৃতিক শক্তিকে নেতিবাচক বলা যায় না৷ শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা উচিত এই শক্তি৷ কিন্তু মাঝে মাঝে এর মূল্যও কম দিতে হয় না''
লাইকো ইকেমুরা ২০ ধরে বাস করছেন জার্মানিতে
লাইকো ইকেমুরা ২০ বছর আগে স্পেন ও সুইজারল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে এসেছেন৷ বসবাস করছেন কোলনে এবং বার্লিনেও, যেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন৷ সেখানে তাঁর অনেক জাপানি বন্ধুবান্ধব আছেন৷ তাদের সঙ্গে মিলে জাপানের বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য তিনি অর্থ সংগ্রহ করছেন৷ লাইকো ইকেমুরার কাছে ১১ মার্চ সারা বিশ্বকেই যেন বদলে ফেলেছে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এটা শুধু জাপানের নয়, বরং গোটা পৃথিবীরই এক সমস্যা৷ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমায় ক্ষতবিক্ষত দেশটিতে আবার পারমাণবিক শক্তি জনিত সমস্যা দেখা দেওয়াটা সত্যি খুব দুঃখজনক৷ কিন্তু আমরা এসব মেনে নিচ্ছি কেন?''
জাপানি ও ইউরোপীয় শিল্পকলার সংমিশ্রণ
লাইকো ইকেমুরার শিল্পকর্মে জাপানি ঐতিহ্য ও ইউরোপীয় শিল্পকলার সুষমা মিলে মিশে গিয়েছে৷ এটা প্রতিফলিত হয়েছে বিশেষ করে তাঁর ছবির বই এবং রেখাচিত্রগুলিতে৷ একটি বই তিনি উৎসর্গ করেছেন বিড়ালদের উদ্দেশে৷ বিড়াল তাঁর কাছে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনের অধ্যায়ের মাঝে যেন এক পথচলার প্রতীক৷ তাঁর স্প্যানিশ শিরোনামের নতুন বই ‘সব কিছু অথবা কিছুই না'-তে তিনি প্রকৃতিকে তুলে ধরেছেন৷ অভিব্যক্তিময় রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন ধূসর মেঘে আবৃত এক প্রকৃতি, বাতাসের শক্তি দিয়ে দূর হয়ে যাচ্ছে সেই মেঘ৷
এ প্রসঙ্গে ইকেমুরা বলেন, ‘‘এই শিরোনামটাতে এলাম কী করে, ভেবে আমি নিজেই অবাক হই৷ ভীষণ এক শক্তি যেন আমার ভেতর থেকে বের হয়ে এল৷ হয়তো বা অজান্তেই আমার মনে ভয়াবহ দুর্যোগের এক পূর্বাভাস জেগে উঠেছিল৷''
পারমাণবিক চু্ল্লির সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত জাপানিদেরও
জাপানের ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয় পড়েন লাইকো ইকেমুরা, বেদনায় ভরে যায় তাঁর মন৷ বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেন, কী করে জাপানিরা চুপ করে আছেন, জার্মানিতে যেখানে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে মানুষ৷ ইকেমুরা মনে করেন, ‘‘সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা হয়তো মুহ্যমান৷ এখন বেঁচে থাকাটাই তাদের মূল সমস্যা৷ আমি আশা করি যে তাঁরাও পরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের কথা ভাববেন৷''
কিছুদিনের মধ্যেই একটি ওয়ার্ক শপ পরিচালনার জন্য জাপানে যাবেন ইকেমুরা৷ অগাস্ট মাসে তাঁর শিল্পকর্মের একটি বড় প্রদর্শনীর আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে৷ একটা দুশ্চিন্তা নিয়েই যেতে হচ্ছে তাঁকে সেখানে৷ এখন ভেঙে পড়া দেশটিকে পুনর্গঠন করার পালা৷ আর এজন্য প্রয়োজন একটি প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক জীবনেরও৷ ইকেমুরার ভাষায়, ‘‘জীবনকে তো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে - এখন আরো বেশি করে৷ আমরা যাই দিতে পারি না কেন, তাও তো কিছু৷''
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী