ভাতা বাড়ানোর রায়
২০ জুলাই ২০১২বর্তমানে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে যে আইন চালু আছে, তা রচিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে৷ সে সময়ে জার্মানিতে শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল৷ ফলে আশ্রয়ের ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার রুখতে এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখাই ছিল সেই আইনের মূল উদ্দেশ্য৷ যতদিন না আবেদনের কোনো ফয়সালা হয়, ততদিন আশ্রয়প্রার্থীদের যতটা কম সম্ভব অর্থ দিয়ে বিভিন্ন রকম অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো৷ আশ্রয়প্রার্থীদের দায়িত্ব ও তাদের জন্য ব্যয়ভারের রাশ জার্মানির রাজ্যগুলির হাতে রয়েছে৷ দেখা গেল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের হাতে ভাতা তুলে দিতে শুরু করেছে৷ শুধু বাভেরিয়া রাজ্যই তাদের জন্য নগদ অর্থের বদলে সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়৷
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য জার্মানিতে যে ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তা একেবারেই সময়োপযোগী নয় – এই মর্মে জার্মানির সাংবিধানিক আদালতের কাছে দুটি অভিযোগ জমা পড়েছিল৷ শুধু মুদ্রাস্ফীতির কারণেই এই সময়কালে জীবনধারণের ব্যয় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷
গত বুধবার আদালত অভিযোগকারীদের পক্ষে রায় দিয়েছে৷ বিচারপতিরা বলেছেন, জার্মানিতে জীবনধারণের জন্য যে ন্যূনতম অর্থের প্রয়োজন, তা জার্মান বা বিদেশি নাগরিক – সবার জন্যই সমান হতে হবে৷ অর্থাৎ দীর্ঘকালীন বেকার ভাতা বাবদ যে অর্থ দেওয়া হয়, বিদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের ভাতার ক্ষেত্রেও সেই একই অঙ্ক স্থির করতে হবে৷ ভাতার অঙ্ক কম রেখে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য জার্মানির আকর্ষণ কমানোর যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তার মৌলিক বিরোধিতা করা হয়েছে৷
আদালতের উপ-প্রধান বিচারপতি ফ্যার্দিনান্দ কিয়ার্শহোফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘বিচারকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে আশ্রয়প্রার্থী সংক্রান্ত আইনের আওতায় যে আর্থিক ভাতা দেওয়া হয়, তা সংবিধান স্বীকৃত জীবন ধারণের ন্যূনতম অর্থের অঙ্কের চেয়ে কম৷ এই অবস্থায় আইন প্রণেতাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করে সংবিধান স্বীকৃত নতুন বিধিনিয়ম স্থির করতে হবে৷''
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, বর্তমানে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা কত? ১৯৯৩ সাল থেকে এ ক্ষেত্রে প্রবণতাই বা কীরকম? দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার আশ্রয়প্রার্থী নথিভুক্ত রয়েছেন, যারা রাষ্ট্রের কাছে ভাতা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন৷ এদের মধ্যে বেশিরভাগই ৬ বছরের বেশি সময় ধরে জার্মানিতে আছেন৷ এদের মধ্যে প্রায় ৬৩,০০০ মানুষের আবেদনপত্র নিয়ে সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া চলছে৷ বাকিদের মধ্যে রয়েছেন সেই সব শরণার্থী, যারা নিজেদের দেশে যুদ্ধের কারণে বাধ্য হয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ আছেন এমন মানুষও, যাদের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন৷ অতএব তাদের উপস্থিতি কার্যত মেনে নেওয়া হচ্ছে৷
১৯৯৩ সালে তৎকালীন জার্মান সরকারের ধারণা ছিল, বছরখানেকের মধ্যেই প্রত্যেক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনপত্র সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে৷ তার ভিত্তিতেই মাসিক ভাতার অঙ্ক কম রাখা হয়েছিল৷
জার্মানির সাংবিধানিক আদালতের রায়ের ফলে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ভাতা বাড়তে চলেছে৷ শুধু তাই নয়, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বকেয়া অর্থও পেতে পারেন তাঁরা৷ কারণ সেই সময় থেকেই দীর্ঘকালীন বেকার ভাতার অঙ্ক বেঁধে দেওয়া হয়েছিল৷
জার্মান সরকার এই রায় মেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছে, যদিও সেই পদক্ষেপ কবে কার্যকর হবে সে বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয় নি৷ শ্রম মন্ত্রণালয় এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এর ফলে আইন আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ সরকারের বিদেশি বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি নিজে ২০০৭ সালেই আশ্রয়প্রার্থীদের ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷
জার্মানিতে প্রায় যে কোনো রাষ্ট্রীয় ভাতার অঙ্ক নিয়েই বিতর্ক দানা বাঁধে৷ ২০১০ সালে দীর্ঘকালীন বেকার ভাতা স্থির করার ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছিল৷ সে সময়ও আদালত বিদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের ভাতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল৷ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ফেডারেল ও রাজ্য সরকারগুলির একটি কমিটিও তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু ঐকমত্য অর্জন করা সম্ভব হয় নি৷
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনের দপ্তর ইউএনএইচসিআর জার্মানির সাংবিধানিক আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে৷ মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানালও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷
আদালতের এই রায়ের প্রেক্ষাপটে আরও একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে বয়সে তরুণ, শিক্ষিত বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়৷ তারা রাষ্ট্রীয় ভাতার বদলে পরিশ্রম করে নিজেরাই অর্থ উপার্জন করতে, কর দিতে প্রস্তুত ও আগ্রহী৷ তাই অনেক মহল দাবি করছে, জার্মান শিল্প ও বাণিজ্য জগতের চাহিদা মেটাতে এদের কাজের সুযোগ দেওয়া হোক৷ সে ক্ষেত্রে সব পক্ষই উপকৃত হবে৷
প্রতিবেদন: কাই আলেক্সান্ডার শলৎস / এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ