জার্মান ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না
২৩ মে ২০২৩ডাক্তাররা কেন গ্রামে যেতে চান না? জার্মানদের কাছে কি তাহলে চিকিৎসকের পেশা আগের মতো আর আকর্ষণীয় নয়?
অনেকের মতো স্টেফান লিশটিংহাগেনও তা মনে করেন না৷ স্টেফান নিজেও চিকিৎসক৷ চিকিৎসা করেন কোলন শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের মারিয়েনহাইডের অঞ্চলে৷ ১৪ হাজার মানুষের ওই এলাকায় তার বাবাও ডাক্তারি করেছেন টানা ৩২ বছর৷
ইন্টারন্যাল মেডিসিন এবং গ্য্যাস্ট্রোএন্টারোলজির বিশেষজ্ঞ বাবা ২০ বছর আগে স্টেফানকে ডেকে জানিয়েছিলেন, তিনি চান এখন থেকেই তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো কাউকে খুঁজে বের করে এলাকাবাসীর সেবার জন্য তাকে তৈরি করতে৷ সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন স্টেফানের ডাক্তার হওয়ার কোনো ইচ্ছে আছে কিনা৷
বাবার সঙ্গে খুব বেশি কথা হতো না স্টেফানের৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলার সময় বাবার ব্যস্ত জীবনের স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেন মারিয়েনহাইডের তরুণ চিকিৎসক স্টেফান লিশটিংহাগেন, ‘‘আমার বাবা সত্যিকার অর্থেই সকাল থেকে সন্ধ্য্যা পর্যন্ত ভীষণ ব্যস্ত থাকতেন৷ বাড়িতে খুব্ কমই দেখতাম তাকে৷ দেখা হলে প্রায়ই আমাকে বলতেন, তুমি তো এমন কাজ (ডাক্তারি) করতে চাও না৷''
কিন্তু অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর আগে বাবা যখন ‘ভবিষ্যতে কে এলাকাবাসীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন' এ চিন্তায় ব্যস্ত, স্টেফান ঠিক করলেন বাবার দুশ্চিন্তা তিনিই দূর করবেন৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলার দিন ২০ বছর বয়সি এক তরুণের রোগ নির্ণয় করেছেন স্টেফান৷ অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে তার৷ প্রতিবেশী এক বন্ধুর ভীষণ শ্বাসকষ্ট৷ তার চিকিৎসা করেছেন৷ এছাড়া ৯১ বছর বয়সি একজন মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন৷ তারও চিকিৎসা করেছেন স্টেফান লিশটিংহাগেন৷
এভাবে নানা বয়সি নানা ধরনের রোগের রোগী দেখে দিন কেমন করে যে কেটে যায় স্টেফান ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না৷ জার্মানির নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা কাজ তো করেনই, মোট কর্মঘণ্টা প্রায়ই এর চেয়ে অনেকক বেশিও হয়ে যায়৷
তা সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টায় কমপক্ষে তিন হাজার ৩০০ রোগি দেখার এই ব্য্যস্ত জীবন কেমন লাগে? কখনো কি মনে হয় ডাক্তার না হলেই ভালো হতো? স্টেফান জানালেন, এ পেশায় আসায় কোনো আক্ষেপ হয় না তার, বরং গর্ব হয়, কারণ, ‘‘আমার কাজে আমিই তো বস, যেভাবে চাই সেভাবেই কাজ করতে পারি আমি৷''
কিন্তু জার্মানির তরুণ চিকিৎসকদের অনেকেই তা মনে করেন না৷ ফলে অনেকেই যেতে চান না শহর থেকে দূরের কোনো গ্রামে৷ ফলে গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারদের নিয়োগ দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার৷ এমন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে রবার্ট বশ ফাউন্ডেশনের গবেষকরা নিশ্চিত৷ তারা সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন, জার্মানিতে প্রতি তিন জনে একজন ডাক্তারের বয়স অন্তত ৬০ বছর বা তারও বেশি৷ ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের অনেকেই অবসরে যাবেন৷ তাদের জায়গায় সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের নিয়োগ দিতে না পারলে কী হবে? রবার্ট বশ ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ ডাক্তারদের শূন্য পদের সংখ্যা ১১০০০ ছাড়িয়ে যাবে!
এমন আশঙ্কাকে দূরে সরাতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে জার্মান সরকার৷ সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাখ বয়স্কদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেশের সব মেডিকেল স্কুলে ৫০০০টি অতিরিক্ত চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র খোলার আহ্বান জানিয়েছেন৷
এছাড়া গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের অভাব দূর করার জন্য ২৩০০ কোটি ই্উরোর বিশাল এক বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়৷
এর আওতায় জার্মানির ১৬টি রাজ্যের মধ্যে নয়টিতে আগামী ১০ বছরে গড়ে তোলা হবে অসংখ্য ডাক্তার৷ সেই ডাক্তারদের স্কুল জীবনে খুব বেশি মেধাবী না হলেও চলবে৷ স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষায় খুব বেশি ভালো নম্বর না পেলেও ‘গ্রাম ডাক্তার' কোটায় চিকিৎস হতে পারবেন তারা৷
শুরুর দিকে স্টেফনের মনে হতো স্বল্প মেধার ছাত্র-ছাত্রীদের ডাক্তার হতে দিলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে৷ কিন্তু ইতিমধ্যে সেই ভুল ভেঙেছে তার৷ তাই স্টেফান মানেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিকল্প এই গ্রাম-ডাক্তাররা নিশ্চয়ই হবেন না, তবে অনেক রোগের চিকিৎসা স্থানীয়ভাবে তারা নিশ্চয়ই করতে পারবেন এবং তাতে রোগীদের উপকারই হবে, ‘‘(বর্তমান পরিস্থিতিতে ) আমাদের তো কিছু একটা করতেই হবে৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যবস্থা এক সময় কোনো-না-কোনোভাবে করা যাবে, কিন্তু পারিবারিক ডাক্তার ছাড়া কাজ চলবে না৷ পারিবারিক চিকিৎসকের প্রয়োজনের কথাটা যে আলাদা করে কেউ এখনো বলছে না- এতে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি৷''
গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক চিকিৎসক কতটা দরকার তা বছর দুয়েক আগে আরব্র্যুকের মানুষেরা খুব বুঝতে পেরেছিলেন৷ সেবার ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গিয়েছিল অনেক বাড়ি-ঘর৷ মারা গিয়েছিলেন অন্তত ১৩৪ জন মানুষ৷ ওই সময় পাঁচজন পারিবারিক চিকিৎসকই এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন৷
ক্লাউস কোর্তে তাদের একজন৷
একটা স্কুল ঘরে শত শত মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার ওই সময়টার কথা ভাবলে এখনো গর্ব হয় তারা৷ তার মতে, পারিবারিক ডাক্তাররা ফুটবল মাঠের গোলরক্ষকের মতো৷ সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুহূর্তে গোলরক্ষকের মতো যাতে ‘শেষ ভরসা'র ভূমিকায় নামার জন্য জার্মানির অনেক পারিবারিক ডাক্তার দরকার বলেও মনে করেন তিনি৷
অলিভার পিপার/ এসিবি