জয়ী ম্যার্কেল
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩২০০৫ সালে আঙ্গেলা ম্যার্কেল যখন প্রথম বার জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন, তখন অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যে তিনি আদৌ চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতা দেখাতে চান কি না৷ সে সময়ে কেউ ভাবে নি, যে ম্যার্কেল তৃতীয় বারের মতো নির্বাচিত হতে পারেন৷ এখনো পর্যন্ত মাত্র দু জন চ্যান্সেলর এমন সাফল্য দেখাতে পেরেছিলেন৷ তাঁরাও খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী সিডিইউ দলের – কনরাড আডেনাউয়ার (১৯৪৯-১৯৬৩) এবং হেলমুট কোল (১৯৮২-১৯৯৮)৷
চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেল-এর অভিষেক কিন্তু কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়৷ চ্যান্সেলর হবার আগেও তিনি ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ দেখিয়েছিলেন৷ সিডিইউ দলের চাঁদা কেলেঙ্কারির মাঝেও তিনি সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে হেলমুট কোল-এর প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন৷ কিছুদিন পরেই তিনি দলের সভাপতি হয়ে ওঠেন৷ তার আগেই তিনি কোল-এর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন৷
ইউরোপে প্রতীকী ব্যক্তিত্ব
ক্ষমতা সম্পর্কে ম্যার্কেল-এর অনুভূতি, তাঁর কূটকৌশল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে জার্মানি তথা ইউরোপে অন্য কোনো নেতার মধ্যে এই মাত্রায় দেখা যায় না৷
ম্যার্কেল জার্মান নাগরিকদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, জার্মানি বর্তমান সংকট থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসবে৷ গত কয়েক বছরে সত্যি জার্মানির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বেকারত্বের হার নজর কাড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে৷ বিদেশে তিনিই জার্মানির স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন৷ জি এইট অথবা ইইউ সম্মেলনের পর শোনা যায় তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ৷ জার্মানির অর্থ তাঁর হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ রয়েছে – এমন আস্থা বার বার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ব্রিটেন-অ্যামেরিকা সহ অনেক দেশে ম্যার্কেল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নারী হিসেবে বিবেচিত হন৷
অভিন্ন মুদ্রা ইউরো-কে বাঁচাবার প্রশ্নে ম্যার্কেল ইউরোপে এক প্রতীকী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন৷ তিনি বলেন, শুধু জার্মানি নয় – গোটা ইউরোপকেই আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে৷ বাকিদের জন্য আর্থিক সাহায্য দিতে কার্পণ্য করেন নি তিনি, তবে সেই সঙ্গে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন৷ প্রতিযোগিতার বাজারে ইউরোপের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে এটাই ম্যার্কেল-এর পথ৷
সিডিইউ-কে বদলে দিয়েছেন ম্যার্কেল
নিজের দল সিডিইউ-কেও বদলে ফেলেছেন ম্যার্কেল৷ দলের মধ্যে প্রথম দিকে তাঁর অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল৷ তাঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ম্যার্কেল তাঁদের সরিয়ে দিয়েছেন অথবা তাঁরা কেলেঙ্কারির কারণে নিজেদের মর্যাদা খুইয়ে বসেছেন৷ আনুগত্যের অভাব ও রাজনৈতিক দুর্বলতা দেখলেই ম্যার্কেল নেতাদের সরিয়ে দেন৷ রাজনীতির জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে৷ তিনি দলের কর্মসূচি বদলাতেও সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন৷ এভাবে তিনি সিডিইউ দলকে রাজনৈতিক আঙিনায় মধ্যপন্থার দিকে ঠেলে নিয়ে গেছেন৷ বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ, বিদ্যুতের জন্য আণবিক শক্তির ব্যবহার ও পরিবার সম্পর্কে সনাতন ধারণা এককালে দলের মৌলিক অবস্থানের মধ্যে পড়তো৷ ২০১১ সালে আণবিক শক্তির ব্যবহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ম্যার্কেল সেই অবস্থান থেকে সরে এলেন৷
সমালোচকরা বলেন, তিনি নিজের দলের পরিচয় ধ্বংস করেছেন অথবা দলকে আরও সামাজিক গণতন্ত্রী করে তুলেছেন৷ অনেকে তাঁকে সুবিধাবাদীও বলেছেন৷ দলের কিছু নেতা তাই সদ্য গজিয়ে ওঠা ‘আল্টারনাটিভে ফ্যুর ডয়েচলান্ড' বা জার্মানির বিকল্প দলে চলে আসেন৷ কিন্তু বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে ম্যার্কেল-এর নীতির জনপ্রিয়তা বেড়েছে৷ ২০০৯ সালে ১৮ বছরের কমবয়সিদের মধ্যে এক সমীক্ষায় সিডিইউ দল শীর্ষ স্থান দখল করেছিল৷
সংকটের সময় ম্যার্কেল-এর নেতৃত্ব
অনেক বছর ধরে নাগরিকদের সমর্থন পেয়ে এসেছেন ম্যার্কেল৷ ক্ষমতা-নির্ভর ভাবমূর্তির মাধ্যমে তিনি সেই আস্থা অর্জন করেছেন৷ সংকটের সময় অনিশ্চয়তার মাঝে তিনি স্থিতিশীলতা ও দিক-নির্দেশনার প্রতি জার্মানদের অভিলাষ কাজে লাগিয়েছেন৷
ম্যার্কেল-এর আচরণের মধ্যেও স্থিতিশীলতার ছাপ দেখা যায়৷ বছরের পর বছর ধরে তাঁর চুলের বিন্যাস প্রায় অপরিবর্তিত থাকে৷ পোশাক-আশাকও প্রায় এক – শুধু রং বদলায়৷ বিশ্ব তোলপাড় হয়ে গেলেও টেলিভিশনের পর্দায় ম্যার্কেল-এর শান্ত উপস্থিতি দেখা যায়৷ বার্লিন শহরে বিশাল নির্বাচনি পোস্টারে ম্যার্কেল-এর দুই হাত ধরের রাখার যে ভঙ্গি দেখা গেছে, তার সঙ্গে স্লোগানটিও ছিল বেশ মানানসই – জার্মানির ভবিষ্যৎ ভালো হাতেই রয়েছে৷
ব্যক্তিগত উষ্ণতা, তবে আড়ালে ব্যক্তিজীবন
সিডিইউ দলের নির্বাচনি পোস্টার দেখলেই বোঝা যায়, চ্যান্সেলর ম্যার্কেল-ই তাদের মূলধন৷ তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এবার তিনি নিজের ব্যক্তিজীবনের কিছু অংশ বাকিদের সামনে তুলে ধরেন৷ যেমন ছুটি কাটানোর সময় তিনি স্বামী ইওয়াখিম সাউয়ার-এর নাতি-নাতনীদের সঙ্গে দাদী হিসেবে সময় কাটিয়েছেন, যার ছবি প্রকাশিত হয়েছে৷ স্বামীও ঘর-সংসারের কিছু খবর জানিয়েছেন৷
ম্যার্কেল-এর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে এর বেশি তেমন কিছু জানা যায় নি৷ বার্লিন শহরের মাঝে পুরানো একটি ফ্ল্যাটে ম্যার্কেল ও তাঁর স্বামী বসবাস করেন৷ ছুটি পেলে কাছেই উকারমার্ক নামের ছোট্ট শহরে চলে যান দুজনে৷ সেখানেই তিনি বড় হয়েছেন৷ সেখানে তাঁর মা এখনো বসবাস করেন৷ ২০১১ সালে তাঁর বাবা মারা গেছেন৷ ম্যার্কেল নিজের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরলেও ব্যক্তিজীবনকে গোপনীয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ রাখতে চান৷ কারণ জনগণের সামনে চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি যেটুকু তুলে ধরেন, তাই তো যথেষ্ট৷