অঞ্জলি রায় গুপ্তা
১৫ আগস্ট ২০১২ঝালকাঠির কীর্তিপাশা গ্রামে ১৯৪৫ সালের ৮ই জুলাই জন্মগ্রহণ করেন অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ বাবার নাম সুশীল কুমার রায় এবং মায়ের নাম শোভা রাণী রায়৷ ১৯৬১ সালে কীর্তিপাশা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন৷ এরপর বরিশালের চাখারে অবস্থিত ফজলুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন তিনি৷ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন অঞ্জলি রায়৷
১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ঝালকাঠির শিরযুগ আজিমুন্নেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি৷ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিকামী মানুষ কীর্তিপাশা স্কুলমাঠে আসত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে৷ একাত্তরের ২৫ মার্চের পর প্রশিক্ষণ আরো জোরদার হয়৷ প্রশিক্ষণ শিবিরের পাশেই তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো৷ এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রশিক্ষণ দিতে ও নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷
মুক্তিযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণের কথা বলতে গিয়ে ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে অঞ্জলি রায় গুপ্তা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বক্তৃতা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে৷ এছাড়া রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেয়৷ বাবা-মা, ভাইবোনদের নিয়ে বাড়ির পাশের একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেন তিনি৷ তাদের লক্ষ্য করে জঙ্গলেই গুলি চালানো হয়৷ তারা গর্ত করে জঙ্গলেই লুকিয়ে থাকেন৷ একসময় গুলি থেমে গেলে গর্ত থেকে বেরিয়ে দেখেন, পুরো জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ ওদিকে আগুনে তাদের বিশাল বাড়ি পুড়ে ছাই৷ সেই ছাই ছুঁয়ে তারা পাঁচ ভাইবোন শপথ করেছিলেন দেশ শত্রুমুক্ত করার৷ আর তাদের বাবা তখন বলেছিলেন, ‘মরতে যখন হবেই, একটা পাকিস্তানি সেনা মেরে তারপর মরো'৷
নিজেদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বিলের মধ্যে পেয়ারাবাগানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন তারা৷ ভাই শ্যামল রায় আর চার বোন অঞ্জলি, সন্ধ্যা, মণিকা ও সুদীপ্তা সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে পেয়ারাবাগানে যুদ্ধে অংশ নেন৷ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ঝালকাঠি-স্বরূপকাঠির সীমান্তবর্তী পেয়ারাবাগানে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন তারা৷ সেখানে পাক সেনাদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়৷ পাক সেনারা হেরে গিয়ে আলবদর, আলশামস আর রাজাকারের সহযোগিতায় পুরো পেয়ারাবাগান পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়৷ ফলে পেয়ারাবাগান ছেড়ে যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের৷
জুন মাসের শেষ দিকে নৌকায় করে পুলিশ আর শত্রুবাহিনী ঝালকাঠি থেকে নবগ্রাম ইউনিয়নে যাতায়াত করছিল৷ একই সঙ্গে তারা নবগ্রাম ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ অঞ্জলি এবং তাঁর সাথী যোদ্ধারা শত্রুর বোটে আক্রমণ চালান৷ এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ককটেল ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পাক সেনাদের নৌকায় হামলা চালিয়েছি৷ এসময় তাদের কয়েকজন নিহত হয়েছিল৷''
যুদ্ধের সময়ের একদিনের বিপদজনক পরিস্থিতির কথা জানান অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ আর ঠিক সেসময় পাক সেনারাও রাস্তায় উঠে গেছে৷ আমি যাচ্ছিলাম পূর্বদিকে৷ কিন্তু দেখি সামনে, পেছনে এবং ডান দিক থেকেও পাক সেনারা আসছে৷ আর বামদিকে ছিল নদী৷ মানে আমাকে ধরার জন্য তারা এভাবে আমাদের ঘেরাও করেছে৷ আমি যে কীভাবে পালাবো তার কোন বুদ্ধিই পাচ্ছিলাম না৷ এমন সময় আমাদের দলের মধ্যে একজন আমাকে হাত দিয়ে ঠেলা দিল যে, আপনি সরে পড়ুন৷ আমি নদীর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে চলে গেলাম৷ কিন্তু আমার পেছন থেকে দু'জন ধরা পড়ে যায় পাক সেনাদের হাতে৷''
দেশ স্বাধীন হয়৷ কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে অঞ্জলির মুক্তিযোদ্ধা ছোট দুই বোনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি৷ তারা চলে যান ভারতে৷ এমনকি তারা ক্ষোভ ও অভিমানে মুক্তিযুদ্ধের সনদ পর্যন্ত নিতে আসেনি বলে জানান অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ এমনকি তারা পাঁচ ভাইবোন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও সনদ পেয়েছেন মাত্র দু'জন৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও তাঁর কর্মস্থলে যোগ দেন অঞ্জলি রায় গুপ্তা৷ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব অঞ্জলি সেই বিদ্যালয়টিকে পরবর্তীতে কলেজ পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেন৷ সেই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: জাহিদুল হক