ঝড় এলে কি আমরা সামাল দিতে পারব?
আমরা ভাষ্য ছেপেছি, ভয়াবহতা লিখেছি, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট কেন ব্যর্থ হল সেটা নিয়ে অনুসন্ধান করিনি। মশা মারার ওষুধের সংকট কেন হল সেটা আমরা খুঁজিনি। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে মিডিয়াই সবেচেয়ে বেশি সচেতন করতে পারে মানুষকে। এখন চীনের করোনা ভাইরাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ বাংলাদেশি মিডিয়াগুলো এজেন্সির রিপোর্ট ছাপছে। এখন আরেকটা রোগে পেয়েছে আমাদের। সেটা হচ্ছে, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে রিপোর্টগুলো আমরা ছেপে দিচ্ছি। এখনকার সাংবাদিকরা পরিশ্রম করতে চায় না। আমি নিজে রিপোর্টার ছিলাম, এখনও রিপোর্ট করি। দিনশেষে তারা যে রিপোর্টটা দিচ্ছে, সেটা হয়ত কোন অনলাইন থেকে কপি করে নিচ্ছে। আমি এমন অনেক রিপোর্ট ফেলে দিচ্ছি, আবার কিছু রিপোর্ট ছাপতেও বাধ্য হচ্ছি।
এটা স্বীকার করতেই হবে এখন দেশে কোন মিডিয়াতেই ভালো চিফ রিপোর্টার, নিউজ এডিটর নেই। অনেক সাংবাদিক সোশ্যাল মিডিয়া দেখেই কোন ধরনের যাচাই বাছাই ছাড়া রিপোর্ট ছেপে দিচ্ছে। ফলে সত্যিটা মানুষ জানতে পারছে না।
এবার করোনা ভাইরাসের প্রস্তুতি নিয়ে দৃষ্টি দেয়া যাক। আমরা কিন্তু ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছি। কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছি, সেটা নিয়ে আমাদের ভালো রিপোর্ট হওয়া দরকার। পাশাপাশি চীনের এই সংকটটা দীর্ঘস্থায়ী হলে আমরা নতুন ধরনের আরেকটা সংকটে পড়ব। সেটা হল গার্মেন্টস খাত। গার্মেন্টস শিল্পে কাপড় থেকে শুরু করে ছোটখাট অনেক জিনিস আমাদের চীন থেকে আনতে হয়। এগুলো আসা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে প্রোডাকশনেও এর প্রভাব পড়বে। আরেকটি বিষয়, আমরা মুখে যাই বলি, করোনা ভাইরাস ডিটেকশনের মতো কোন যন্ত্রই নেই এয়ারপোর্টে৷ ঘনবসতির এই দেশে যদি সংক্রমণ শুরু হয় তাহলে পরিস্থিতি কি হবে? যতই বলি আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, তখন কিন্তু রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে৷ এয়ারপোর্টগুলোতে শুধু জ্বর আছে কিনা সেটা দেখছে, কিন্তু ডিটেক্ট করার মতো যন্ত্রপাতি নেই। এটা নিয়ে রিপোর্ট হচ্ছে, ভাসা ভাসা। ভেতরে গিয়ে ইনডেপথ কোন রিপোর্ট হচ্ছে না।
আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো এখন আর ভেতরের খবর বের করছে না। মানুষ কিন্তু সংকট হয়েছে, এই খবর পড়তে চায় না। তারা জানতে চায়, কেন সংকট হল? আমি নিয়মিত ডয়চে ভেলের রিপোর্ট দেখি। কারণ তারা হয়ত পুরনো একটি বিষয় নিয়েই রিপোর্ট করছে, ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তারা রিপোর্টগুলো করছে। ফলে তাদের রিপোর্টে কিন্তু ভিন্নতা আছে।
একেক মিডিয়া একেক স্টাইলে রিপোর্ট করবে এটা ঠিক। কিন্তু ভেতরের খবর তো বের করতে হবে। সেটা কি হচ্ছে? এখানে কি গবেষণামূলক রিপোর্ট হচ্ছে? আমি বলব হচ্ছে না। আমি প্রতিদিন সকালে ২০/২২টি সংবাদপত্র দেখি। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি কাগজেও দেখলাম না, করোনা আক্রান্ত হলে আমাদের দেশে বাঁচার উপায় কী? আমার নিজের কাগজেও নেই। কোন সাংবাদিক এটা নিয়ে লেখার চেষ্টাই করেনি।
এখন যেভাবে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে তাতে কোন দেশই ঝুঁকিমুক্ত না। ২৪টি দেশে এটা কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নিয়ে একটা বড় ধরনের ক্রাইসিস চলছে। আমাদের ডেঙ্গু থেকে বের হতে অনেক দিন লেগে গেছে। এ কারণেই বলছি, করোনা নিয়ে আমাদের আরো ভালো প্রস্তুতি থাকা দরকার। আমাদের প্রচুর মানুষ বাইরে যাচ্ছেন, বিদেশিরাও আসছেন। প্লেন খালি যাচ্ছে না, খালি আসছেও না। করোনার কারণে কিন্তু মানুষের বিদেশে যাওয়া থেমে নেই। এখন যে ধরনের প্রস্তুতি আমাদের আছে, তার ফাঁক গলে কেউ বেরিয়ে যেতে পারেন। এর কারণেই আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) কাজ করছে। কিন্তু আমাদের একজন রিপোর্টারও খুঁজে বের করেননি, এখানে ঝড় আসলে শুধু তাদের একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে কিনা। আমাদের বুঝতে হবে মুখে মুখে নয়, আসলেই আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব কিনা।
সত্যি বলতে কি, আমাদের এখানে এখন বহু টেলিভিশন চ্যানেল, শত শত সংবাদপত্র আছে। এমনকি উপজেলা থেকেও দৈনিক পত্রিকা বের হচ্ছে। কিন্তু এখানে সাংবাদিক তৈরী হচ্ছে না। কারণ হচ্ছে, কারা টেলিভিশন পাবে সেখানে যাচাই বাছাই নয় দলীয় দৃষ্টিকোন কাজ করে। যে কারণে ভালো সংবাদপত্র বা ভালো টেলিভিশন হচ্ছে না।
আমরা এখন সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে আছি। এটা আমাদের আরও কাবু করে ফেলছে। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র ব্যবস্থা হতে পারে সম্মিলিত প্রয়াস। আমি নিজেও কোন ধোয়া তুলশি পাতা না, তারপরও বলছি, আগে সাংবাদিকতায় ছিল সাংবাদিকতা করে তারপর রাজনীতি। আর এখন আগে দল তারপর সাংবাদিকতা। এভাবেই আমরা দিনের পর দিন কম্প্রোমাইজ করছি। এখানেই আমরা সাংবাদিকতা নীতির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেছি। এমনভাবে কম্প্রোমাইজ করেছি যে, সত্য গোপন থাকছে।
ডেঙ্গু যখন শুরু হল, তখন কিন্তু কোন মিডিয়াই ব্যর্থতা খুঁজে বের করিনি। কারণ সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারে, মেয়র সাহেব ক্ষুব্ধ হতে পারেন। অথবা এটা লিখলে বিজ্ঞাপন পাব না, এই কারণেও আমরা লিখছি না। এই অবস্থা থাকলে মানুষ সত্য জানতে পারবে না। সত্যের সঙ্গে আপোষ করার কোন সুযোগ নেই।
অনুলিখন: সমীর কুমার দে
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷