তৈরি পোশাক শিল্প
২৯ মার্চ ২০১২একজন লাকি'র গল্প...
তাসলিমা আক্তার লাকি৷ ঢাকার নিম্নবিত্ত ঘরের এক মধ্যবয়স্কা নারী৷ প্রায় ২০-২১ বছর ধরে কাজ করেন গার্মেন্টস কারখানায়৷ সেই দু'শো টাকা মজুরি দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু৷ বর্তমানে মেশিন অপারেটর-এর পদে কাজ করছেন ঢাকার বাংলামোটরে অবস্থিত একটি কারখানায়৷
দু'শো টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে আজ তাঁর বেতন হয়েছে চার হাজার তিনশ' টাকা৷ লাকি বলছেন, ‘‘ছোট্ট বেতনের এই চাকরিটাই পেটে ভাত জুগিয়েছে৷ সন্তানের মুখে ফুটিয়েছে হাসি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে৷ আমার সন্তানদেরে ফালাইয়া এদের বাপে চইলা যায়৷ এদের বাপ চইলা যাবার পরে, গার্মেন্টসের এই চাকরিটা কইরাই ছেলেমেয়ের খাওয়া-পড়ার খরচ চালাইসি৷''
বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন লাকি৷ সেই মেয়েও অপারেটর পদে এখন কাজ করে গার্মেন্টস কারখানায়৷ মেয়ের এই চাকরিটাও লাকিই জুটিয়ে দিয়েছেন৷
লাকির দুই ছেলের মধ্যে একজন এবার দশম শ্রেণিতে পড়ছে৷ আরেক জন পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে৷ তবে গত কিছুদিন ধরে লাকির স্বামী আবার তার ছেলেদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে নিজেই৷ তাই দুশ্চিন্তা যেন খানিক কমেছে লাকির৷
আরো অজস্র লাকি আছে শহরে শহরে...
লাকির মতোই অজস্র নারী কাজ করছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায়৷ কিশোরী ও মাঝ বয়সী নারীরা মফস্বল এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে যোগ দিচ্ছে তৈরি পোশাক কারখানায়৷
কিশোরগঞ্জের সখিনা ও কারিমা, নীলগঞ্জের সমলা, বাসিরন ও ঝুমা এবং ময়মনসিংহের এহসানও গার্মেন্টস এর খাতায় লেখা তালিকারই কয়েকটি নাম৷ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে এরা৷ এদের কেউ ঢাকায়, কেউ গাজীপুর আর কেউ স্থায়ী হয়েছে নারায়ণগঞ্জের কারখানায়৷
আশি ভাগই নারী শ্রমিক...
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম'এর সভানেত্রী মোশরেফা মিশু জানালেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছে অন্তত ৪৫ লাখ শ্রমিক৷'' আর এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের ‘‘মোট আশি ভাগই নারী কর্মী'', উল্লেখ করেন তিনি৷
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্প৷ ‘‘প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০ ভাগেরও বেশি এ খাত থেকেই আয় হয়'' বলেও জানান মোশরেফা মিশু৷
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নারীর ক্ষমতায়ন...
দরিদ্র পরিবারের অনেক মেয়েই আগে বাড়ি বাড়ি ঝি'এর কাজ করতো৷ কিংবা দারিদ্র্য মেনে নিয়ে নির্ভর করতো স্বামী বা বাবার আয়ের প্রতি৷ কিন্তু গার্মেন্টস কারখানাগুলো নারীকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে৷ ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলেই মনে করেন নারী নেত্রী মোশরেফা মিশু৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘যারা গার্মেন্টস-এ কাজ করে, তারা প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠায়৷ এ টাকার উপরে পারিবারিক একটা নির্ভরশীলতাও তৈরি হয়৷ এই টাকা দিয়েই হয়তো ছোটো-খাটো একটা ব্যবসা করে পরিবারের একজন৷ ছেলে-মেয়ে বা ছোটো ভাই-বোনের পড়া-লেখার খরচও হয়তো দেয় অনেকই নিজের বেতনের টাকা থেকেই৷ আর এভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখছে গার্মেন্টসের কর্মীরা৷''
মোশরেফা মিশু আরো বলেন, অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়েছে৷ ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেড়েছে নারীর স্বাধীনতা৷ হয়েছে নারীর ক্ষমাতায়নও৷
তাঁর মতে, ‘‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর কোনোই স্বাধীনতা নেই৷ তবে যে সব মেয়ে বা নারী গার্মেন্টসে কাজ করছে, দেখা যাচ্ছে, নিজের জীবনের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই এখন সে নিজে নিচ্ছে৷ তাছাড়া পরিবারিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখছে তারা৷ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বিতা অর্জনের ফলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর এই স্বাধীনতা এসেছে৷''
তবুও নুন আনতে পানতা ফুরোয়...
মোশরেফা মিশু বলছেন, গত দুই দশকে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ৷ মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে দফায় দফায়৷ সে তুলনায় বেতন বাড়ে নি৷ তাই তাঁর মতে, যে নারী শ্রমিক দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে, তার জীবন সমস্যার নিগূঢ়ে বন্দি৷
মোশরেফা মিশুর ভাষায়, ‘‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে তিন হাজার টাকা৷ এই তিন হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকা, খাওয়া, ওষুধপাতির খরচা চালানো অসম্ভব৷''
তিনি বলেন, ‘‘এতো অল্প টাকায় মনুষ্যচিত জীবনযাপন অসম্ভব৷ তাই দেখা যায় যে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশই বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকে৷ কিন্তু বস্তিতেও এখন ঘর ভাড়া বেড়েছে৷ আর গত কিছু দিনে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ৷ তাই সব মিলিয়ে দেখা যায়, খেয়ে না খেয়ে কোনো ভাবে বেঁচে আছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা৷''
এই অবস্থায়, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন পুনর্বিবেচনা করাটা সরকারের উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
শুধু বেতন নয়, আছে আরো অন্য সমস্যাও...
গার্মেন্টস-এ কাজের পরিবেশ অত্যন্ত অনুন্নত অভিযোগ করেছেন নারী নেত্রী মোশরেফা মিশু৷
তিনি বলেন, ‘‘বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তা অধিকাংশ গার্মেন্টসে এখনো নিশ্চিত করা হয় নি৷ বাথরুমে ব্যবহার করা হয় যে পানি সে পানিই শ্রমিকরা খেতে বাধ্য হয় অনেক ক্ষেত্রে৷ ফলে প্রতিবছর অসংখ্য শ্রমিক জন্ডিসে আক্রান্ত হয়৷ বিশেষ করে গরমের সময়ে জন্ডিসের ঘটনা বেশি ঘটে৷''
জন্ডিসের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে বলে দাবি করেন তিনি৷
আলো আছে, পাশে আছে অন্ধকার...
যে মেয়ে ছিল বাবার বোঝা, অনেক ক্ষেত্রে সেই আজ পরিবারের আয়ের উৎস৷ যাবার উপায় নেই দেখে যে স্ত্রী দিনের পর দিন স্বামীর ঘরে মুখ বুজে দারিদ্র সয়েছে; সয়েছে নির্যাতন আর লাঞ্ছনা, সেই আজ উপার্জনক্ষম৷ তাই তারও বেড়েছে কদর৷
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যে সব সংগঠন তারা বলছে, সমাজে নারীর অবস্থার এই ইতিবাচক পরিবর্তন খুবই আশাব্যাঞ্জক৷
নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক কারখানার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষক ও শ্রমিক নেতারা৷
তবে নারী শ্রমিকেরা অতি অল্প আয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন৷ শ্রমিক নেতারা বলছেন, ‘‘এটা অমানবিক৷ এই অবস্থা দূর করা দরকার৷''
তাই কারখানাগুলো যেন শ্রমিকের বেতন বাড়ায়, সে লক্ষ্যে, সরকারের আরো সহায়ক পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলেও মনে করছেন তাঁরা৷
প্রতিবদেন: আফরোজা সোমা
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ