থাইল্যান্ডের হিজাব পরা সমকামী ফুটবলারদের গল্প
৩০ নভেম্বর ২০২০থাইল্যান্ডের অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল দক্ষিণাঞ্চলের পাত্তানি শহরে নিজের বইয়ের দোকান দেন আন্তিচা৷ সেখানেই প্রথমে শুরু হয় লিঙ্গ এবং যৌনতার নানা ধরন নিয়ে আলোচনা৷ তখন আন্তিচা বুঝতে পারেন, তার মতো অনেকেই আছেন যাদের কোথাও যাওয়ার নেই৷
এমন মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এবং কিছু করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার আগ্রহ থেকেই জন্ম হয় বুকু ফুটবল ক্লাবের৷ মালয় ভাষায় বুকু অর্থ বই৷ আন্তিচার এই ক্লাবে সমকামী, উভকামী নারীরাও সহজেই একাত্ম হতে পারেন৷
অক্টোবরে বুকু ক্লাব আয়োজন করে তাদের প্রথম এলজবিটি ফুটসাল টুর্নামেন্ট৷ এই খেলা ফুটবলের মতো নিয়ম হলেও শক্ত কংক্রিটের মেঝেতে খেলা হয়, মাঠের আকার থাকে ছোট এবং দুই পক্ষে খেলোয়াড় থাকেন পাঁচ জন করে৷
দক্ষিণাঞ্চলের তিন প্রদেশ থেকে মোট ছয়টি দল অংশ নেয় এই টুর্নামেন্টে৷ এর মধ্যে অনেক খেলোয়াড়ই পরে এসেছেন হিজাব৷ তাদের পরিবারের সদস্যরাও খেলা দেখতে এসেছেন, কেউ ভালো খেললে চিৎকার করে উৎসাহও দিয়েছেন৷
আন্তিচা যখন ছোট ছিলেন, তখন এমন পরিস্থিতি ছিল অকল্পনীয়৷
এখন আন্তিচার বয়স ৪৩ বছর৷ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে বৌদ্ধ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি৷ আন্তিচা বলছিলেন, ‘‘ফুটবল থাইল্যান্ডে খুব জনপ্রিয় হলেও, খুব বেশি মেয়ে তা খেলে না৷ বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের অনেক বেশি বাধার মুখে পড়তে হয়, কারণ তাদের পরিবারের অনেকে এটিকে পাপ বলে মনে করেন৷’’
বুকু ক্লাবের একটি খেলা দেখতে দেখতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে আন্তিচা বলছিলেন, ‘‘ফুটবল খেলা তাদেরকে স্বাধীনতার স্বাদ দেয়৷ একইসঙ্গে হয়রানি ও বৈষম্য মোকাবিলা করতে এই খেলাই তাদের শক্তি যোগায়৷’’
থাইল্যান্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল বৌদ্ধ সমাজের হলেও ধীরে ধীরে সমকামিতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা হলেও পালটেছে৷ ১৯৫৬ সালেই সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়৷
কিন্তু তারপরও এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষ নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন৷ মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, রাজধানী ব্যাংককের বাইরে অনেক পরিবারই তাদের মেনে নিতে চায় না৷
তিন বছর ধরে বুকু ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলছেন সাফিয়া আওয়েয়া৷ তার বাবা একজন ইমাম৷ সাফিয়ার বাবা তার সমকামী হওয়া এবং ফুটবল খেলা মেনে নেননি৷ ফলে একসময় সাফিয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন এবং চুল ছোট করে কেটে ফেলেন৷ এখন নিজের কর্মক্ষেত্রে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেলে তিনি হিজাব পরেন৷
রয়টার্সকে সাফিয়া বলছিলেন, ‘‘আমি আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে আমার সমকামী হওয়া এবং ফুটবল খেলার কোনো বিরোধ খুঁজে পাই না৷ তারপরও যারা আমার বিশ্বাস নিয়েই প্রশ্ন তোলে, আমি তাদের এড়িয়ে চলি৷ কারণ তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা সম্ভব না৷’’
এই বছরের শুরুতে থাই মন্ত্রিসভা সমলিঙ্গের মানুষের সম্পর্ককে দাম্পত্য জীবনের প্রায় সমান মর্যাদা দিয়ে সিভিল পার্টনারশিপ বিল অনুমোদন দিয়েছে৷
এই বিল পার্লামেন্টে পাস হয়ে আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে৷ এই আইন হলে তাইওয়ানের পর থাইল্যান্ডই হবে সমলিঙ্গের মানুষের দাম্পত্য নিবন্ধনের অনুমতি দেয়া এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ৷ এই আইনের ফলে সন্তান দত্তক নেয়া এবং উত্তরাধিকার, সম্পত্তির অধিকারের মতো অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে সমকামী অধিকারকর্মীদের আশা৷
থাইল্যান্ডে এলজিবিটি অধিকারকর্মীরা ধীরে ধীরে রাজনীতিতেও এগিয়ে আসছেন৷ গত বছরের নির্বাচনে দেশটিতে নতুন চার সমকামী আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী পদে লড়াই করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের এক সদস্য৷
বৈষম্যের প্রতিবাদে থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী যে আন্দোলন চলছে সেখানেআ সরব ভূমিকায় আছেন এলজিবিটি অধিকার কর্মীরা৷
আন্তিচা মনে করেন, এই আইন এলজিবিটিদের সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখবে৷ তবে নারী-পুরুষের বিয়ের মতো সমকামী বিয়েরও সমান স্বীকৃতি চান তিনি৷
সরকার অবশ্য এখনই সে উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ এখনও সিভিল কোডে বিয়ে বলতে নারী ও পুরুষের দাম্পত্য বন্ধনকেই বোঝানো হয়৷
দেশটির বিচার মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিভাগের পরিচালক নারেলুক পাইরচাইয়াপুম বলেন, ‘‘আমাদের মূল লক্ষ্য বিয়ের সমান স্বীকৃতি৷ কিন্তু আমরা অন্য সব দেশের মতোই এটা ধাপে ধাপে করতে চাই৷ থাই সমাজের জন্য এটা একটা বিশাল পরিবর্তন৷ ফলে মানুষের বিষয়টা বুঝতে ও গ্রহণ করতে কিছুটা সময় লাগবে৷ ধর্মীয় গ্রুপ এবং অন্যদের সঙ্গে আমাদের এ নিয়ে একটা সমঝোতাতেও পৌঁছাতে হবে৷’’
অবশ্য কবের মধ্যে সমান স্বীকৃতি দেয়ার কথা ভাবছে থাই সরকার, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট সময় জানাননি পাইরচাইয়াপুম৷
ক্লাব পরিচালনার পাশাপাশি পাত্তানি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম ও দর্শন পড়ান আন্তিচা৷ নতুন আইন পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার পার্টনারকে প্রকাশ্যেই বিয়ে করতে চান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি সমাজকে দেখাতে চাই, সবার নিজেদের মতো করে মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে৷’’