দরকার একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন
৬ নভেম্বর ২০২০তিনি হাসতে হাসতে জানালেন, কালকে বিশেষ কিছু হবে না, ভোট নেয়া অলরেডি শুরু হয়ে গেছে৷
তার কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম৷ বলে কী! একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এত আয়োজন তাহলে সবই লোক দেখানো? বিএনপি কি জানতো না এরকম পরিস্থিতি হবে? কালকে সাধারণ ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কী করবে তাহলে? এমন জল্পনাকল্পনা যখন করছি তখন আরো একজন ফোন করলেন৷ জানালেন, ঢাকার কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে রাতের আঁধারে ব্যালট বক্স ভর্তি করা হচ্ছে৷ আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম৷ ঢাকার রাস্তাঘাট তখন একেবারেই ফাঁকা৷ তাই গাড়ি নিয়ে একটি ভোটকেন্দ্রে হাজির হতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগলো৷ গেটের বাইরে কিছুটা অন্ধকার হলেও কেন্দ্রের মধ্যে আলো জ্বলছিল৷ আর একটু পরপর আসা যাওয়া করছিলেন কিছু মানুষ৷ তাদের গলায় ঝুলানো ক্ষমতাসীন জোটের এক প্রার্থীর কর্মী হিসেবে দেয়া আইডি কার্ড৷
আমি ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দিল৷ জানালো, সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ৷ আমি একা ছিলাম, কথা বাড়ালাম না৷ তবে আশেপাশে খানিকটা ঘুরে দেখলাম৷ অন্য কোন প্রার্থীর কর্মী বা সমর্থকের কোন দেখা পেলাম না৷ বুঝলাম, ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে আর সেটা ক্ষমতাসীনরাই করছে৷ আর ক্ষমতায় না থাকা দলগুলো সেই করাকে আটকাতে কিছুই করছে না৷ হয়ত এটাই তাদের নির্বাচনী কৌশল ছিল কিংবা কিছু করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে বসেছিল তারা৷
পরেরদিন সকালে সেই একই ভোটকেন্দ্রে আবারো গিয়েছিলাম৷ সঙ্গে আরো কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন৷ সাংবাদিক হিসেবে আমরা ভোট শুরুর আগে ব্যালট বাক্সগুলো দেখতে চাচ্ছিলাম৷ কিন্তু এক পুলিশ কর্মকর্তা কোনভাবেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিলেন না৷ নানা বাহানা দিলেন, বিধিনিষেধের কথা বললেন৷ মোদ্দা কথা হচ্ছে, ব্যালট বাক্স স্বচ্ছ হলেও সেটি ভোট শুরুর আগে কোনভাবেই দেখতে দেবেন না তিনি৷
যাহোক, ভোটের দিন পুরান ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখলাম ভোটাররা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভোট দিতে পারছেন না৷ প্রযুক্তিগত কোন এক জটিলতা দেখিয়ে তাদের সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছিল৷ এক ভোটকেন্দ্রের ভেতর কিছুক্ষণ ঘুরেও বিএনপির কোন এজেন্ট খুঁজে পেলাম না৷ যখন বেরিয়ে যাবো তখন হন্তদন্ত হয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করে জানালেন তিনি বিএনপির এজেন্ট৷ তার আইডি কার্ডে দেখলাম শুধু হাতে লেখা একটা নাম আছে কিন্তু কোন ছবি নেই৷
বলতে পারেন, শুধু ঢাকা শহরের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে কি পুরো বাংলাদেশের চিত্র বোঝা যায়? না, যায় না৷ তবে রাজধানী অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়৷ সেদিন রাতে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি৷ তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি৷ কাউকে বলা হয়েছে আপনার ভোট হয়ে গেছে, কাউকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সমর্থকদের সামনেই ভোট দিতে হয়েছে সেই প্রার্থীকে৷ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যারা কিছুটা নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত, তারাও জানিয়েছেন আগের রাতে ব্যালট ভর্তি করা হয়েছে অনেক কেন্দ্রে৷
এরকম একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পরও বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি তেমন কিছুই করতে পারেনি৷ এমনকি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে কঠোর আইনি লড়াইয়ের পথেও আগায়নি তারা৷ অথচ তাদের জোটের প্রধান বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আইনজীবীদের একজন৷ বরং যে কয়েকটি আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থীরা জিততে পেরেছেন তাদেরকে আমরা দেখেছি সংসদে যেতে, যা প্রকারান্তরে বর্তমান সংসদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে৷
বাংলাদেশের এই নির্বাচন একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে৷ দেশটির নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে রাজনৈতিকীকরণ করা হয়ে গেছে৷ ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকলেও কার্যত সেটা হচ্ছে না৷ এরকম যখন পরিস্থিতি, সেখানে একটি দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়৷
ইউরোপের দেশগুলোর নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে প্রার্থক্যটা এখানেই সবচেয়ে বড়৷ জার্মানিতে ২০১৭ সালের নির্বাচন কভার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে৷ সেসময় ঘুরে ঘুরে দেশটির বিভিন্ন বড় শহরে নির্বাচনি প্রচারনা দেখেছি, নির্বাচনের দিন বার্লিনে কয়েকটি ভোটকেন্দ্রেও গিয়েছি৷ সবচেয়ে অবাক লেগেছিল এটা দেখে যে ভোটকেন্দ্রের সামনে কোন প্রার্থীর কোন কর্মী সমর্থকদের ভীড়তো নেইই, এমনকি পুলিশের দেখা পাওয়াও দুরূহ ৷ ভোটাররা সুন্দরভাবে নিজেদের ভোট দিয়ে চলে গেছেন৷ আর ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশে সাংবাদিকদের কোন রকম বাধাও দেয়া হয়নি৷ আমি ভোটকেন্দ্রের মধ্য থেকে লাইভও করেছি সেসময়৷
জার্মানিতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিয়েও কোন প্রশ্ন নেই৷ ফলে এখানে জনগণের ভোট চুরি কিংবা নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে এটা কারো মাথাতেই আসে না৷
মোদ্দা কথা হচ্ছে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ চালাতে হলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা হরণ করে গণতন্ত্র আশা করা একেবারেই বোকামি৷