দুই মন্ত্রীর কীর্তি, কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবিতে চাঞ্চল্য
১১ জানুয়ারি ২০২৪প্রমাণসাপেক্ষ হলেও কেন্দ্রীয় সংস্থার এমন দাবি ঘিরে বিস্ময় জেগেছে। শুরু হয়েছে বিতর্ক।
মন্ত্রীই দুর্নীতির মাথা?
তৃণমূল কংগ্রেসের সাবেক মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এই সংক্রান্ত মামলায় শীর্ষ আদালতের সময়সীমা অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে চার্জশিট দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। চারটি মামলার চার্জশিটেই নাম রয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর।
পার্থের ঘনিষ্ঠ এক আমলা, সাবেক শিক্ষাকর্তার নামও চার্জশিটে রয়েছ। সূত্রের খবর, একাধিক শিক্ষকের নামও রয়েছে তাতে। তবে কার্যত কিংপিন হিসেবে দেখানো হয়েছে পার্থকে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। তার বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা ও অলঙ্কার উদ্ধার হয়। গ্রেপ্তার করা হয় তাকেও।
চার্জশিটে নাম রয়েছে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীরও। নিয়োগ দুর্নীতিতে চাকরি গিয়েছে তার কন্যার।
মন্ত্রীর ঝুলিতে 'কমিশন'?
কোনো কাজের বিনিময়ে অবৈধভাবে আদায় করা টাকাই 'কমিশন' বা 'কাটমানি'। কিন্তু সরাসরি মন্ত্রী কমিশন নিচ্ছেন, এই অভিযোগ একেবারে বিস্ফোরক।
রেশন দুর্নীতির তদন্তে আদালতে ইডি-র দাবি, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ধান কেনাবেচা থেকে নিজেই কমিশন নিতেন। সমস্ত রাইস মিল মালিকদের এই কমিশন দিতে হত। প্রতি কুইন্টালে ২০ টাকা কমিশন নিতেন মন্ত্রী। রেশন দুর্নীতিতে ধৃত বাকিবুর রহমান এবং তার রাইস মিলের কর্তাকে জেরা করে এ তথ্য জানা গিয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় সংস্থার।
পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর যে পরিমাণ ধান কেনাবেচা হয়, তা টাকার অঙ্কে বিপুল। প্রতি কুইন্টালে কমিশন বাবদ মন্ত্রীর ঝুলিতে শয়ে শয়ে কোটি টাকা জমা পড়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় সংস্থার। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর সাবেক পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য রেশন দুর্নীতিতে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার বিদেশ মুদ্রা লেনদেনের ব্যবসা রয়েছে। অভিযোগ, শঙ্করের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন জ্যোতিপ্রিয়।
মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তৃণমূল কোনো ক্ষেত্রে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, কারো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে। পার্থের বিরুদ্ধে ঘাসফুল নেতৃত্ব পদক্ষেপ নিলেও এখনো মন্ত্রী রয়ে গিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়। সরাসরি তার পক্ষে সওয়াল করেছেন দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই কথা বলা যায় অনুব্রত মণ্ডলের বিষয়ে। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সম্পাদক কয়লা ও গরু পাচার মামলায় তিহাড় জেলে বন্দি।
তৃণমূলের বক্তব্য, বিজেপির নির্দেশে কেন্দ্রীয় সংস্থা ষড়যন্ত্র করছে। বেছে বেছে বিরোধী নেতাদের জেলে পুরছে। তবে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের বিপুল সম্পত্তি, নগদ টাকা থেকে ব্যাঙ্কে মেয়াদি আমানত, অলঙ্কার থেকে জমিজমা কীভাবে হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দুর্নীতির অতীত-বর্তমান
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দুর্নীতির অভিযোগ আগেও বারবার উঠেছে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে স্টিফেন হাউস কেনার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সম্পত্তি কিছুই ছিল না বলা চলে।
কংগ্রেস আমলে সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে বামেরা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল। সে সব প্রমাণিত হয়নি। তিনি নিজের সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে ওয়াংচু কমিশন বসিয়েছিলেন। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধার্থশঙ্কর ব্যবস্থা নেন একাধিক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
গত শতকের আটের দশকে বাম শরিক আরএসপি-র নেতা ও তখনকার মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর সূত্রে বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির কথা উঠে এসেছিল। বাম সরকার তাতে অস্বস্তিতে পড়ে। নয়ের দশকে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার মুখে শোনা গিয়েছিল 'চোরেদের মন্ত্রিসভা' শব্দটি। এর পর মুখ খোলেন আর এক সিপিএম নেতা ও মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী। তার ভাষায় বামেরা 'ঠিকাদারদের সরকার' চালাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুই প্রমাণিত হয়নি।
তৃণমূলের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে আরো ব্যাপক আকারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিমলশঙ্কর নন্দ বলেন, "আগে দুর্নীতি ছিল ছোট আকারে, এখন তার পরিমাণ বেড়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় নিজের সরকারের বিরুদ্ধে কমিশন বসিয়েছিলেন, আর এখন শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে মদত দেয়া হচ্ছে দুর্নীতিতে। নিচুতলায় আর্থিক নয়ছয় আগেও হয়েছে। তবে এই সরকারের আমলে তা একেবারে উঁচু মহল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।"
অনেকের মতে, এর ফলে দুর্নীতি সমাজে বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। যারা নীতির শিক্ষা দেবেন, তাদের নামও উঠে আসছে। নিয়োগ দুর্নীতির চার্জশিটে একাধিক শিক্ষকের নামও আছে বলে সূত্রের খবর। শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করছি ঠিকই। কিন্তু শিক্ষকরা যদি এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, সেটা দুঃখের। দোষী যারাই হোক, সকলেরই শাস্তি পাওয়া উচিত।"