দুর্নীতির আমি দুর্নীতির তুমি
১৪ জুন ২০১৯ঝামেলা পাকালো পাসপোর্ট৷ কারণ, মেয়াদ আছে আর মাস তিনেক৷ নবায়ন ছাড়া গতি নেই৷ সাত দিনের মধ্যে নবায়নকৃত পাসপোর্ট পেতে, সরকারি হিসেব মতে জমা দেয়া হলো, ছয় হাজার ৯শ টাকা৷ তারপর পাসপোর্ট অফিসে সব কাগজপত্রসহ আবেদন জমা দিতে গিয়ে দেখা গেলো, চাইলে দুই দিনের মধ্যেও পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব৷ তবে গুণতে হবে আরো দুই হাজার টাকা৷
দর কষাকষি চললো কিছুক্ষণ৷ সুযোগ পেয়ে, অন্য একজন এসে বললো, তাকে দেড় হাজার দিলেই কাজটা করে দেবে৷ পরের গল্পটার আর দরকার নেই৷ এই দৃশ্য বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্র৷ ঘুস ছাড়া সরকারি অফিসগুলোর দরজাটাও খুলতে চায় না৷
ঢাকায়, সাধারণত বাসে চেপে আমি যাতায়াত করি৷ কখনো দেরি হয়ে গেলে কিংবা তাড়াহুড়ো থাকলে, অ্যাপের মাধ্যমে মোটর সাইকেল খুঁজি৷ একদিন নির্ধারিত স্থানে আমাকে নিতে মোটর সাইকেল এলো৷ চালক খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ভাই, অ্যাপটা বন্ধ করে দেন৷ চলেন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি৷ অ্যাপে যা ভাড়া দেখায়, তার চেয়ে দশ টাকা কম দিয়েন৷' অর্থ দাঁড়ালো, অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতা যোগাড় করবে ঠিকই, কিন্তু আয়ের ভাগ দেবে না৷
এমন ঘটনা যে শুধু একবার হয়েছে তা নয়, আমার নিজের সঙ্গে হয়েছে অন্তত পাঁচ ছয়বার৷ শুধু তাই নয়, নিয়ম থাকার পরেও, ঢাকায় কোনো দিন মিটারে সিএনজি চড়তে পারিনি৷ মিটার চালুর কথা বললে, নিয়মানুসারে যে ভাড়া আসবে, তার চেয়ে অন্তত ২০/৩০ টাকা বেশি দেয়ার শর্ত জুড়ে দেয় চালক৷
এগুলো হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ কিন্তু এসব ছোট ঘটনা দিয়েই অনুমান করা যায়, দুর্নীতির থাবা সমাজের কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ বাংলাদেশের দুর্নীতির বিস্তার দেখতে কোনো অফিস আদালতে যেতে হয় না৷ একদিন, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে একটা বাসে উঠে মতিঝিল পর্যন্ত চোখ কান খোলা রাখলেই তা দৃশ্যমান হবে৷
দেখা যাবে, কোনো বাস যাত্রী ভাড়া না দিয়ে নেমে যাচ্ছে, কিংবা অচেনা রুটের যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বেশি ভাড়া৷ শিক্ষার্থী (শিক্ষার্থী নয় এমন লোকজন) পরিচয়ে কম ভাড়া দেয়া কিংবা কম দূরত্বের কথা বলে বেশি দূরত্ব চলে যাওয়া৷ আর জানালার পাশে বসে বাইরে দৃষ্টি রাখলেই, নিশ্চিত দেখা যাবে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের হাতে ঘুস গুঁজে দিয়ে নিয়মহীন যানবাহনের চলে যাওয়া৷
পৃথিবীতে সম্ভবত বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যে দেশে খাদ্যেও ভেজাল দেয়া হয়৷ আর সেটা কতোটা প্রকট হয়েছে, রমজানে চলা অভিযানগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়৷ যারা অভিযান পরিচালনা করছেন, তারাও নিজেদের প্রশ্নের বাইরে রাখতে পারছেন না৷ ঈদের আগে আড়ংয়ে অভিযান, নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷
গণমাধ্যমকর্মী বলেই হয়তো মাঝে মাঝে সইতে হয়, নানা মানুষের উৎকট সব আব্দার৷ অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা, তদ্বির করে ফাইলটা পাস করানো, চাকরির সুপারিশ--বিনিময়ে থাকে ঘুসের প্রস্তাব৷ কাজের মাত্রায় ঘুসের পরিমাণ ঠিক হয়৷ বিনয়ের সঙ্গে এড়িয়ে যেতে চাইলে, উল্টো কথা শুনতে হয়৷ অমুকজন তো এ কাজ করেই চলে, তমুক তো সেদিনও সেটা করে দিলো৷ হয়তো তিনি মিথ্য বলেন না! কারণ সবখানে বিরাজ করছে দুর্নীতি৷ অভ্যস্ত হতে হতে, নিজের অজান্তে আমরা ছোটোখাটো দুর্নীতিকে প্রতিদিন প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি৷
সবমিলিয়ে আমার বিশ্বাস, দুর্নীতি দেশের প্রধানতম সমস্যা৷ ফলে এ সমস্যা জিইয়ে রেখে কাঙ্খিত লক্ষ্য পৌঁছানো কঠিন৷ ২০২৩ সালের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হারকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যটা হোঁচট খাবে, যদি না দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা না যায়৷ বিকাশ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি৷ বাড়ছে মাথাপিছু আয়৷ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হবার পথ চলায় মিলেছে প্রাথমিক স্বীকৃতি৷ কিন্তু দুর্নীতির মাত্রা কমার কোনো আশাব্যঞ্জক খবর নেই৷
এ বছরের ২৯ জানুয়ারি, দুর্নীতি ধারণা সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল৷ আমি নিজেই গিয়েছিলাম সংবাদ সংগ্রহ করতে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে৷ দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০তে মাত্র ২৬। ঠিক তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৭তে ছিল ২৮। সেবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নিচের দিক থেকে ১৭। ২০১৮তে চার ধাপ অবনমন হয়ে, অবস্থান হয়েছ ১৩।
সেদিন দুর্নীতির বেড়ে যাওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান৷ তার মতে, দেশে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ঘোষণা আছে ঠিকই, কিন্তু নেই তার বাস্তবায়ন৷ সমাজের উঁচু তলার লোকদের বিচারের আওতায় আনার উদাহরণ কম৷ ব্যাংক খাতে চলছে অবারিত দুর্নীতি৷ জালিয়াতি, ভূমি-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ--সবমিলিয়ে দুর্নীতি পেয়ে যাচ্ছে।
ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুদক ও অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। দুদক নিম্ন-মধ্য পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও, উচ্চ পর্যায়ে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ সংকুচিত হয়ে গেছে গণমাধ্যম ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো৷ থামানো যাচ্ছে না, অর্থ পাচার৷ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বলা হয়, দুর্নীতি ঠেকাতে, জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন৷ আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে, আনতে হবে বিচারের আওতায়৷ সংসদে নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা৷
তবে, টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে, প্রশাসনকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত এবং নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন৷ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তিনি৷ সরকার প্রধানের এমন ভাষ্য নিশ্চিতভাবে আশাজাগানিয়া৷ আমাদেরও প্রত্যাশা, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা হোক৷ যদিও অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়৷ প্রতিটি নতুন সরকারের ঘোষণা, আমাদের স্বপ্ন দেখায়৷ কিন্তু সময়ের স্রোতে সেসব সুবচন নির্বাসনে চলে যায়৷ এবার অন্তত তা মিথ্যে প্রমাণ হোক৷